বঙ্গ-নিউজ ডট কম:সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর হচ্ছে। এখন থেকে শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীই নন, তাদের স্বামী বা স্ত্রীরাও সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেলে সেটি অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। এর শাস্তি হবে চাকরিচ্যুতি। এমন বিধান রেখেই সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯-এর সংশোধনী আসছে। এরই মধ্যে আচরণ বিধিমালা সংশোধনীর একটি খসড়া তৈরি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শিগগিরই এটি আরও যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত করে প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। তবে বিগত সময়ে সরকারি চাকরিজীবীদের স্বামী বা স্ত্রী যারা রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই আচরণবিধি প্রযোজ্য হবে না। আগামীতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র।সরকারি চাকুরেদের স্বামী বা স্ত্রী রাজনীতি করতে পারবেন নাসূত্র জানায়, বিদ্যমান বিধিমালায় সরকারি কর্মচারীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তাদের পরিবার-পরিজনের বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। শুধু বলা রয়েছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্ত্রী বা স্বামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকলে তা সরকারকে অবহিত করতে হবে। কিন্তু এ বিধান কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না। মন্ত্রী-এমপিসহ প্রায় হাজারো রাজনীতিকের স্ত্রী বা স্বামী সরকারি চাকুরে হলেও তারা বিষয়টি এতদিন সরকারকে অবহিত করেননি। কোনো কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেই সক্রিয় রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। নিজ নিজ এলাকার বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন তারা। এমন হাজারো অভিযোগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদের লাগাম টেনে ধরতেই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করতে যাচ্ছে। এ ছাড়া আচরণ বিধিমালার আরও কয়েকটি ধারায় সংশোধন আসছে। সংশোধনী আচরণ বিধিমালায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ অর্জন ও উপহার গ্রহণের পরিধিও দ্বিগুণ করা হচ্ছে। তবে সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো কর্মকর্তা ইচ্ছামতো আর বাড়ি-গাড়ির মালিক হতে পারবেন না। তাদের প্লট, ফ্ল্যাট ও গাড়ি কিনতে হলে আয়ের উৎস সম্পর্কে স্পষ্ট জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হবে।এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী সমকালকে বলেন, সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলছে। এরই মধ্যে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কাছে সংশোধনীর বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে এবং তারা মতামতও দিয়েছে। এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকও হয়েছে। শিগগিরই এটি চূড়ান্ত করা হবে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্র জানায়, আচরণ বিধিমালা সংশোধনীর একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সংশোধনীতে কর্মকর্তা-কর্মচারীর পরিবার-পরিজনদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না থাকতে পারার বিষয়টি স্পষ্ট করা হচ্ছে। এ ছাড়া বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ অর্জন ও উপহার গ্রহণের পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। কারণ, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে সংশোধনীর যে মতামত পাওয়া গেছে, এতে বেশিরভাগই কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ অর্জন ও উপহার গ্রহণের পরিমাণ বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিদ্যমান বিধিমালায় এর পরিমাণ যা রয়েছে, তা বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এসব দিক বিবেচনা করে এ পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান সমকালকে বলেন, বিধি সংশোধন বা নতুন বিধি প্রণয়ন করাটাই কোনো মুখ্য বিষয় নয়। এটি প্রতিপালন করা হয় কি-না, সেটি দেখার বিষয়। সরকারি চাকুরেদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার বিষয়ে বিদ্যমান বিধিমালায় কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছে, তা কতটুকু পালন করা হয় সেটি আগে দেখতে হবে। নামমাত্র একটি বিধিমালা হলো আর এটি পালন হলো না, এটি তো হতে পারে না। আর নতুন বিধিমালায় সরকারি চাকুরের স্বামী বা স্ত্রী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না_ এমন বিধান রাখা হলে সেটি কতটুকু বাস্তবসম্মত হবে, সেটিও দেখতে হবে। কারণ, কোনো গণতান্ত্রিক বিষয় বিধি দ্বারা রুদ্ধ করা যায় না। এটিও সরকারের মাথায় রাখতে হবে।
জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকের পর, বিশেষ করে ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের সময় থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা শুরু হয়। বিএনপি সরকারের আমল হয়ে এই ধারা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন চালাতে গিয়ে নানা সমস্যাও হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণেই সরকার তাদের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততার নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করছে। সরকারি আচরণ বিধিমালার ২৭(বি)-এর ২ ধারায় আরও দুটি উপধারা যুক্ত করা হচ্ছে। এতে বলা হচ্ছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজনীতি বা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না। কারও বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে বরখাস্ত করা হবে। এ ছাড়া আরেকটি উপধারায় জুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের স্বামী বা স্ত্রী রাজনীতি করার বিষয়টিও। এ ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর স্বামী বা স্ত্রীও তার চাকরিকালীন কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না। যদিও বিদ্যমান বিধিমালায় স্বামী-স্ত্রী রাজনীতির বিষয়ে এমন কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল না। এখানে বলা ছিল, স্বামী বা স্ত্রী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে সরকারকে অবহিত করতে হবে। সংশোধনীতে এটিকে বিলুপ্ত করে সরকারি চাকুরের স্বামী বা স্ত্রী রাজনীতি করতে পারবেন না বলে বিধান রাখা হচ্ছে।
প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কারণ, সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী বা স্বামী রাজনীতি করলে ওই কর্মকর্তা এ ক্ষেত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন, এটিই স্বাভাবিক। এ দরজা বন্ধ করে দিলে তার ক্ষমতা প্রয়োগের বিষয়টি থাকল না। স্বামী-স্ত্রীর পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যাতে চাকরিজীবনে সক্রিয় রাজনীতিতে কোনোভাবে সম্পৃক্ত হতে না পারেন, সে বিষয়টিও আচরণ বিধিমালায় নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, একজন চাকরিজীবীর সব সময়ে দেশের জন্য কাজ করা উচিত, কোনো দলের জন্য নয়। তবে এ বিষয়ে আবার অনেক কর্মকর্তাই দ্বিমত পোষণ করে বলেন, একজন সরকারি চাকুরে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে পারবেন না, এটি মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু তার স্বামী বা স্ত্রী রাজনীতি করবেন কি-না, সেটি তো আচরণ বিধিমালা দিয়ে ঠিক করা উচিত হবে না। গণতান্ত্রিক দেশে সবারই ব্যক্তিস্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।সরকারি আচরণ বিধিমালার আরও কয়েকটি ধারায় সংশোধনী আসছে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদ অর্জন ও উপহারের পরিধি দ্বিগুণ করা হচ্ছে। বিদ্যমান বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্বশুরবাড়িসহ যে কোনো জায়গা থেকে ২৫ হাজার টাকার বেশি উপহার নিতে পারবেন না। সংশোধনী বিধিমালায় এটি দ্বিগুণ করে ৫০ হাজার টাকার করা হচ্ছে। সম্পদ অর্জনের পরিমাণও দ্বিগুণ করা হচ্ছে। এখন থেকে তাদের পাঁচ লাখ টাকার নিচে অস্থাবর সম্পত্তি ও ১০ লাখ টাকার নিচে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে অনুমতি নিতে হবে না। তবে এর বেশি হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। আয়ের উৎস সম্পর্কে জানাতে হবে। এ ছাড়া প্রতিবছরের জানুয়ারি মাসের মধ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক মূল্যায়ন রিপোর্ট (এসিআর) জমা দেওয়ারও বিধান রাখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, বিদ্যমান সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালায় অনেক বিষয় অস্পষ্ট। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে অস্বাভাবিক পরিমাণ অর্থ ও সম্পদের মালিক হয়েছেন। বর্তমান বিধিতে বলা আছে, ইমারত নির্মাণ করতে হলে আয়ের উৎস উল্লেখ করাসহ সরকারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। ফলে সরকারি কর্মচারীরা বাড়ি নির্মাণ করার বদলে বাড়ি ও ফ্ল্যাট কিনছেন। এতে করে আয়ের উৎস দেখাতে হচ্ছে না কিংবা সরকারের অনুমোদন নেওয়া লাগছে না।
সংশোধিত বিধিতে বলা হচ্ছে, বাড়ি কিংবা ফ্ল্যাট নির্মাণ বা কেনার ক্ষেত্রে প্রকৃত বাজারদর উল্লেখ করে বিনিয়োগকৃত অর্থের উৎস জানানোসহ সরকারের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীর বাস্তবে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি না থাকলে অনুমোদন মিলবে না। আত্মীয়স্বজন কিংবা কারও কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ দেখালে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঋণ প্রদানকারীর পক্ষ থেকে লিখিত প্রত্যয়নপত্র থাকতে হবে। আপন ভাই হলেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। আয়কর রিটার্নেও এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য থাকতে হবে। এ ছাড়া সংশোধনীতে সরকারি কর্মচারীদের সামাজিক দাওয়াত খাওয়ার ওপর নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। সচরাচর দেখা যায়, সরকারি কর্মকর্তারা প্রটোকলের বাইরে কর্মস্থল এলাকায় ঠিকাদারসহ সমাজের বিশেষ ব্যক্তিদের বাসায় গিয়ে কিংবা নিমন্ত্রণ পার্টিতে যোগ দিয়ে দাওয়াত খেয়ে থাকেন। এতে করে দুর্নীতির নানা পথ প্রশস্ত হয় এবং নিমন্ত্রণদাতারা প্রশাসনিকভাবে বিভিন্ন সুবিধা নিয়ে থাকেন। এ জন্য ডিসি-এসপিসহ সরকারি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী তার কর্মস্থলের আশপাশের এলাকায় দাওয়াত খেতে পারবেন না। তবে এ ক্ষেত্রে নিকট আত্মীয়স্বজনের বিয়ে-শাদি ও সামাজিক অনুষ্ঠান গণ্য হবে না। নতুন এ বিধিমালা প্রণয়ন হলে সরকারি কর্মকর্তারা ইচ্ছা করলেও যত্রতত্র দাওয়াত খেতে পারবেন না।
বাংলাদেশ সময়: ৭:২৩:০৭ ৪৪৮ বার পঠিত