বঙ্গ-নিউজ:ভেজালের ভিড়ে মানুষ যখন তটস্থ ঠিক তখন আসল বা নির্ভেজালের কদর বেড়েছে স্বাভাবিকভাবে। মানুষ এখন দামের দিকে না তাকিয়ে আসল খুঁজতে ব্যস্ত। এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতাও চলে সামর্থ্যবানদের মধ্যে। কেউ নদী থেকে তাজা মাছ ধরিয়ে আনছেন, তো কেউ আবার বাগান থেকে সারমুক্ত শবজি তুলে আনছেন গাড়ি বোঝাই করে। কেউ এক বছর আগেই আম-লিচুর বাগান কিনে রাখছেন। নির্ভেজাল পণ্য সংগ্রহের প্রভাব পড়েছে কোরবানির পশুহাটেও।
জানা গেছে, এবার পশুহাটে যাতে বিষাক্ত ইঞ্জেকশন দেয়া গরু ওঠাতে না পারে সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিং সেল খোলা হচ্ছে। ঢাকা সিটি করপোরেশন এ-সংক্রান্ত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে বলে সূত্র জানিয়েছে। এ কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে পশুচিকিৎসক ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা থাকবেন। তারা অবৈধ পন্থায় মোটাতাজা করা গরু শনাক্ত করে সেগুলো আটক, বেপারিদের গ্রেফতার, তাদের জেল-জরিমানাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়াও এই সেল হাটের ইজারাদারদেরও এ ব্যাপারে মোটিভেশন করবে বলে জানা
গেছে।
জনপ্রিয় হচ্ছে অর্গানিক গরু : স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন, ভিটামিন ট্যাবলেটসমৃদ্ধ মোটাতাজা করা গরু কেনা থেকে এবার বিরত থাকবে বেশির ভাগ মানুষই। অন্তত টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের সচেতনতামূলক প্রচারণা তারই ইঙ্গিত করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, যেসব ক্রেতা প্রতি বছর দামি বড় গরু কোরবানি দেন, তারা এবার আগেভাগেই ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেছেন। এদের অনেকেই তাদের সুযোগ-সুবিধামতো গ্রামগঞ্জে কোরবানির ‘অর্গানিক’ গরু পালন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। গ্রুপভিত্তিক এসব গরু পালন করে তারা ভালো লাভবানও হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কথা হয় অর্গানিক কোরবানির পশু পালন উদ্যোক্তা উত্তরা কাবের সদস্য সিরাজুল হক তালুকদার রতনের সাথে। তিনি বলেন, তিন মাস আগেই হাট থেকে ছোট সাইজের শুকনা গরু কিনে সেগুলোকে মাঠের ঘাস, খড়, খৈল, ভুসি অর্থাৎ প্রাকৃতিক খাবার দিয়ে বড় করেছি। প্রাকৃতিকভাবেই আমাদের গরু বেড়ে উঠেছে। তিনি জানান, প্রতিটি গরুর পেছনে কেনাসহ ৬০ হাজার টাকা খরচ করে ৮০ হাজার টাকার গরু পাচ্ছি। তার চেয়ে বড় কথা, আমাদের গরুতে কোনো ভেজাল বা মেডিসিন নেই।
জানা গেছে, একই প্রক্রিয়ায় অনেকেই উট, দুম্বা, বিশেষ জাতের ভেড়া, ছাগল পালন করেছেন এবারের ঈদকে সামনে রেখে। ফলে এবার ঢাকার হাটগুলোয় দেশে উৎপাদিত উট, দুম্বা, পাঁঠা, ভেড়ার দেখা মিলবে ক্রেতাদের সাথে। মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেছনে একটি খামারে উৎপাদিত হচ্ছে মরুর জাহাজ খ্যাত উট। এ ছাড়াও মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমে উন্নত জাতের গরুর পাশাপাশি দুম্বা, বিশেষ জাতের ভেড়া ও পাঁঠা পালন হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। অনেক খামারি বাণিজ্যিকভাবেও অর্গানিক গরু-ছাগল লালন-পালন করেছেন। পণ্য বেচাকেনার অনলাইন মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে তারা এরই মধ্যে পশুর ছবিসহ বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেছেন। যে কেউ ইচ্ছা করলে অনলাইনেই তাদের পছন্দের পশুর বুকিং দিতে পারেন। চাহিদামতো হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও থাকছে।
মোটাতাজা করা গরু না কেনার পরামর্শ
এ দিকে মোটাতাজা করা পশু না কেনার ব্যাপারে এবার ব্যাপক সচেতনতার সৃষ্টি হয়েছে। এ লক্ষ্যে মিডিয়াগুলোর ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি চিকিৎসক ও পশুবিশেষজ্ঞরাও গুরুত্বপূর্ণ প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারা ‘মেডিসিন কাউ’-এর ভয়াবহতার দিকগুলো তুলে ধরছেন। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলেছেন আমাদের বাকৃবি সংবাদদাতা আরিফুল ইসলাম। তিনি জানান, পাম ট্যাবলেট, স্টেরয়েড ও ডেক্সামিথাসনের মতো ভয়ঙ্কর তিকারক ওষুধ শরীরে নিয়ে বেড়ে উঠছে কোরবানির গরু। বিষাক্ত রাসায়নিকের হাইডোজ প্রয়োগ করে অল্প দিনে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তাজা করা হচ্ছে অবলা এই পশুকে। আর বিষাক্ত হয়ে ওঠা এসব গরুর গোশত খেলে লিভার, কিডনি, হৃদযন্ত্র, মস্তিষ্ক তিগ্রস্তসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্কবার্তার পরও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে সারা দেশে চলছে গরু মোটাতাজা করার তোড়জোড়। বেশি লাভের আশায় অনেক খামারি পশুচিকিৎসকদের পরামর্শ না মেনেই এই বিপজ্জনক কাজ করছেন। আবার কোনো কোনো এলাকায় হাতুড়ে চিকিৎসক ও বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্ররোচনায় ফাঁদে পা দিচ্ছেন তারা। এ থেকে বাঁচার জন্য সাধারণত দেশী জাতের হালকা-পাতলা ও ছোট-মাঝারি আকারের গরু কেনার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুজাফফর হোসেন। তিনি বলেনÑ প্রাকৃতিক ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে স্বল্প খরচে গরু মোটাতাজা করা সম্ভব। এতে খামারি যেমন লাভবান হবেন তেমনি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকেও রক্ষা পাবেন মানুষ।
ঈদুল আজহা উপলে অসাধু ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফার জন্য গরুকে পাম ট্যাবলেট খাইয়ে ফুলিয়ে ফেলছেন। অতি দ্রুত এক সপ্তাহের মধ্যে গরু মোটাতাজা করতে ক্যারেন্ট পাউডার খাওয়ানো হচ্ছে। ট্যাবলেট খেয়ে গরু বেলুনের মতো ফুলে ওঠায় ট্যাবলেটের নামও দেয়া হয়েছে পাম্প ট্যাবলেট। পাশের দেশগুলো থেকে চোরাইপথে ডেক্সামিথাসন গ্রুপের বিভিন্ন ট্রেড নামের ড্রাগ আমাদের দেশে আসে। খামারিরা ট্যাবলেট গুঁড়ো করে গরুর প্রতিদিনের খাবারের সাথে মিশিয়ে খাওয়ান।
এই ডেক্সামিথাসন গরুর শরীরে ঢুকে আস্তে আস্তে কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। ফলে কিডনি শরীরের রক্ত পরিশুদ্ধ করতে পারে না। রক্ত থেকে পানি আলাদা হতে পারে না। ফলে গরুর শরীরে পানির পরিমাণ বেড়ে যায় ও গরুকে অনেক মোটাতাজা ও সতেজ মনে হয়।
ডেক্সামিথাসন একধরনের হরমোন-জাতীয় ড্রাগ। ফলে তা গরুর শরীর থেকে গোশতের মাধ্যমে মানুষের শরীরে চলে যায়। এসব হরমোন এতই মারাত্মক যে, গোশত রান্না করার পরও তা নষ্ট হয় না। ফলে তা মানুষের শরীরে গিয়ে অনাকাক্সিক্ষত বৃদ্ধি, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর অঙ্গের বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগের সৃষ্টি করে। অনেক েেত্র বন্ধ্যাত্ব, মেয়েদের অল্প সময়ে পরিপক্বতা ও শিশুদের অল্প বয়সে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এক হাজার পাম ট্যাবলেটের দাম ৫০ থেকে ৭০ টাকা। প্রতিদিন একটি গরুকে শরীর অনুযায়ী ৫ থেকে ২০টি ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়। তাতে এক মাসের মধ্যে গরু ফুলে যায়।
গরু ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে আরো জানা যায়, এক সপ্তাহের মধ্যে কারেন্টের মতো গরুকে ফুলানো-ফাঁপানোর জন্য ক্যারেন্ট পাউডার খাওয়ানো হচ্ছে। এক কেজি ওজনের ওই পাউডারের দাম ৩২০ থেকে ৬৫০ টাকা। দিনে দু’বার একটি গরুকে ২০ থেকে ৩০ গ্রাম পাউডার খাওয়ানো হলে এক সপ্তাহের মধ্যে গরু মোটা হয়ে যাবে। এ ছাড়া কিছু দিন পরপর ইঞ্জেকশনও দেয়া হয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুজাফফর হোসেন বলেন, এসব ক্ষতিকর পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। খামারির জন্যও এভাবে মোটাতাজা করা ক্ষতির কারণ হতে পারে। কেননা এসব গরু দ্রুত বিক্রি করতে না পারলে কিডনি নষ্ট হয়ে অল্প সময়েই মারা যায়।
কোরবানির গরু কেনার পরামর্শে ড. হোসেন বলেন, সাধারণত হরমোন খাওয়ানো গরুর শরীর ফোলা ও চতুষ্কোণাকৃতির নাদুসনুদুস হবে, চাপ দিলে স্পঞ্জের মতো মনে হবে। গরু হাঁটতে চাইবে না, পা-ঘাড় মোটা হবে, শরীর প্রশস্ত হবে। তিনি সে জন্য কোরবানির জন্য দেশী জাতের মাঝারি আকারের গরু কেনার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের মানুষের আমিষের চাহিদার চেয়ে এখনো উৎপাদন অনেক কম। আর এভাবে রাসায়নিক দিয়ে গরু মোটাতাজা করা অব্যাহত থাকলে মানুষ গরুর গোশত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। এতে দরিদ্র কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সাথে সাথে আমিষের চাহিদাও পূরণ হবে না। ফলে এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক ড্রাগস যেন কেউ বিক্রি ও ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি এসব মুনাফালোভী অসাধু খামারির বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়েও জোর দেন
বাংলাদেশ সময়: ৭:২৮:৩৪ ৪৪০ বার পঠিত