৫ই ফেব্রুয়ারি ২০১৩ ভোরটা ছিল সুন্দর। তখনও আকাশের গায়ে ছিল বেশ কিছু তারা। খুব ভোরে শহরে কাটাব বলে শহরতলী থেকে চলে এলাম। পথে ভোরের সূর্য গায়ে আদরের হাত বুলাল।সকালটা বেশ মনোমুগ্ধকর শুরু হলো। চায়ের কাপে আয়েসি, চুমুক দিতে দিতে প্রতিদিনের খবরের কাগজে চোখ বুলানোর মতন ফেইস বুকের হোম পেইজে চোখ রাখলাম। হঠাৎ একটা লেখায় চোখ আটকে গেলো।
একজন স্ট্যাটাস দিল, আমি শাহবাগে গেলাম।’ একে একে আরও কয়েকজন।”
বেশ একটা উত্তেজনা ছড়াল কী হতে যাচ্ছে? এই ছেলেদের দু একটা স্ট্যাটাস থেকে কী বদলাবে কোন কিছু? আদালতের রায়?
আমার শান্ত সকালটাও কেমন অশান্ত হয়ে গেল। কাজের জায়গায় প্রিয়জন অসুস্থ হয়ে পরেছে। সেখান থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যস্ত সময় কীভাবে যেন ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা ঔষধ আর চিকিৎসার মাঝে থমকে গেলো।
দুদিন কোন খবরই নিতে পারলাম না, চারপাশে কী হচ্ছে।
এরমাঝে অনেক জল গড়িয়েছে। একে একে বিন্দু থেকে সিন্ধু হয়ে ফুঁসছে শাহবাগ। সারা দেশে সারা পরেছে। আবাল বৃদ্ধ, বনিতা শাহবাগের রাজপথে এসে বসে আছে। স্লোগানে মুখরিত হচ্ছে। আলপনা আঁকছে। সময় অতিবাহিত করছে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীতে।
ওরা ঘরে ফিরবে না। দেশের আনাচ কানাচ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন কোনে ঢেউ জেগেছে। সবাই আন্দোলনে শরিক যে যেখানে আছে, সেখান থেকে। বিদেশ থেকে অনেকে দেশে চলে যাচ্ছে। অস্থির এক ভালোলাগার আহ্বান। যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালর বাঁশির সুরে সবাই আবেগ আপ্লুত।
সুরটা শ্বাসত, ভালোবাসার, চিরসত্য। কে ডেকেছে, কার আহ্বান তা বড় নয় সুরটা মানুষের প্রাণের। নিজের অস্থিতের। তাই না চাইতেই মনে দোল লাগছে। প্রাণ থেকে সবাই সমর্থন করছে।অপেক্ষা ছিল অনেক বছরের, এই বাঁশির ডাকের।
ফেইস বুকে খবর দিয়ে শাহবাগে গিয়ে বসে থাকল যে ছেলেগুলো। তখন কী এই ছেলেরা জানত লাখ লাখ মানুষের সমাগম হবে এমন করে শাহবাগে। পরিকল্পনা করেছিল, অনেক টাকা পাওয়ার? অনেক কিছু যা ঘটে গেলো এমন কিছু হবে বলে কি তাদের নিজেদেরও ধারনা ছিল?
ছিলনা। কারণ তারা আর কারো কথা জানেনি। তারা নিজেদের বিশ্বাসটা প্রকাশ করেছে তখন। মানুষ তাদের সমর্থন করেছে। কারণ তারা তাদের মনের কথাটি বলেছে এজন্য। যা মানুষের মনে হৃদয়ে রক্তে, অস্তিত্বে মিশে আছে অথচ তারা প্রকাশ করতে পারেনি নিজেদের মতন। কিন্তু এই ছেলেদের চাওয়ার মাঝে একটি ভিত্তি, নিজেদের অস্তিত্বের দাবী ফুটে উঠেছে। যা প্রকাশ করে বাংলাদেশ। যা প্রকাশ করে বিরোধীদের নির্মূল হওয়া। যার জন্য প্রতিক্ষা বছরের পর বছর।
এক এক করে এত জনতার সমাগম হলো। ওরা কি কাউকে ডেকে নিয়ে এসেছিল? ভালোবেসে ওদের কে কেউ যদি টাকা দিয়েও থাকে তারজন্য কাদের এতো কষ্ট হচ্ছে? সব দলের লোকজনও তো বিভিন্ন ধনী, দলকর্মি বা অনুরাগীর থেকে টাকা নেয়। অনেকে ইচ্ছে করে দল বাঁচিয়ে রাখতে অর্থের যোগান দেয়। তা নিয়ে তো কেউ কথা বলে না।
প্রথমে মনে করা হলো হুজুগ, দুদিন পর কেটে যাবে কিন্তু তারা যখন রাস্তা আঁকড়ে পরে থাকল, তাদের যখন অনেক বেশী সমর্থক পৃথিবী ব্যাপী, তখন কারো মনে খুব জ্বালা ধরে গেলো এ জ্বালা তাদের অস্থিত্বের। যারা ক্ষতির সম্মুখিন এই ছেলেদের কার্যক্রমে, তারা উঠেপরে লেগে গেলো এদের নির্র্মল করতে। ওরা অসম্ভব পরিকল্পিত, সংগবদ্ধ। ওরা একটা দল। যা বাংলাদেশের অস্থিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান করে।
শুরু হলো নানা রকম বদনাম ছড়ানো। শুরু হলো প্রপাগাণ্ডা লেখালেখি। ওদেরকে নির্মূল করার চেষ্টায়।
নাস্তিক ব্লগার আখ্যা দেয়া থেকে, হত্যা, করা হলো। ছড়ানো হলো নানা রকম বদনাম। দেশে বিদেশে লেখা এবং কুৎসা সংগবদ্ধ ভিত্তি ভেঙ্গে দেয়ার আয়োজন চলল। কারা ক্ষতির সম্মুখিন এই ছেলেদের কার্যক্রমে, তাদের গায়ে আগুন তো লাগবেই। তাদের চেষ্টা তো চলবেই বিপরীত স্রোতের চোরাগুপ্তা হামলার।
চারপাশের ধর্মভীরু মানুষ কে কতটা পবিত্র জীবন যাপন করে? অথচ তাদের অস্থিত্বে নাড়া পরল। শাহবাগে ছেলে মেয়ে একসাথে রাতদিন পরে আছে তাই। কারো সাথে কারো সম্পর্ক যদি থাকে আর তারা এক সাথে বসে থাকে তার চেয়ে বড় বিষয় অসংখ্য ঘরে বসা মানুষের চেয়ে ওরা নিজের জীবন বিপন্ন করে রাস্তায় পরে আছে। একটি বিশ্বাসকে অবলম্বন করে। যা দেশের অস্তিত্বের।
যখন গনজাগরণ মঞ্চ তৈরী হলো তখন ইমরানকে তার দলনেতা বানান হলো, যে ভালো করে কথা বলতে পারে না। অথচ তার কথায় সারা দেশ বাসী এক সাথে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি গায়। সংসদের সভাসদসহ শেখ হাসিনাও সংসদের সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীতে অংশ নেন। সর্বপরি সমর্থন থাকে গনজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রমে।
অথচ পুর্নবান নির্বাচিত হওয়ার পর রাজাকারের বিচার গতি হয় শ্লথ। হঠাৎ করে কয়েক মাস ব্যাপী পথে বসে থাকা কর্মিদের পথ থেকে তুলে দিতে খর্গহস্ত হয় সরকার। দাবার গুটি উল্টে যায়।
খুব অল্পতে বিশ্বাস ভেঙ্গে যায় বাঙ্গালীর। নানান প্রশ্ন জাগতে থাকল,
শংকর জাতি শংকর মন শতধা দ্বিধা বিভক্ত। তারা মনের মতন হচ্ছে না বলে, সন্দিহান এবং অবিশ্বাস করতে থাকে। একটু একটু করে, নানা রকম সন্দেহের ভিত্তিতে দ্বিধান্বিত মানুষ বিভক্ত হতে থাকল। মুখ ফিরিয়ে নিতে থাকল। অনেক সন্দেহ দানা বেঁধে ডালপালা মেলে শক্তপোক্ত হতে থাকল। টাকা পয়সা লোটপাটের কথা আসল। এই টাকা কারা দিল, কেন দিল? যারা টাকা দিল তাদের কি বক্তব্য? ইমরান বিশ্বাস যোগ্য নয়। তবে তাকে দুতিন দিন বা দু এক মাসে কেন বাতিল করা হলো না? অনেক লোক সমাগম হলো অনেক শুভাকাঙ্খি এলেন, অনেকে অনেক দ্বায়িত্ব নিলেন অনেক পরামর্শ দিলেন। কিন্তু সব শেষে এক চেতনার অধিকার নিয়ে এক থাকতে পারল না কেউ। ভেঙ্গেচুরে খান খান। স্বার্থের প্রয়োজনে সব চুরচুর হয়ে গেলো। রয়ে গেলো শুধু মুখের বুলি। আর এখন যা হচ্ছে মঞ্চের ত্রিভঙ্গ চিত্রের মারামারি। হাস্যকর অবস্থা। এই তো চেয়েছিল। যারা চেয়েছে, তারা ঠিক দূরে বসে হাসছে। আর হস্যকর করে তুলেছে চেতনা, অস্থিত্ব।
তবে কি এই ভাবেই চলবে, বিয়াল্লিশ বছর পরও কোন সমাধান হবে না? অস্থিত্ব বিলীনকারীই জয়ি হবে আড়াল থেকে, কিছু সুবিধাবাদীর মদদে।
ঐ গল্পটার কথা মনে পরে, শয়তানের এক সদস্য, বেচারা নিরহ গোছের মানুষের মাঝে শয়তানীর চেতনা সে জাগাতে পারে না। শয়তান বলে দিল, আজ যদি কোন অঘটন ঘটাতে না পারিস তবে তোর সদস্য পদ বাতিল হবে শয়তানের দুনিয়ায়।
সদস্য পদ বাতিলের ভয় মনে নিয়ে সে পৃথিবীতে এলো সকাল বেলা। আজ কিছু একটা করতেই হবে। কি করবে কিছুই না পেয়ে। এক দোকানে বসে গুড় খেতে লাগল। দোকানের খুঁটিতে গুড় মাখা হাত মুছে সে পাশে বসে ভাবতে লাগল কি করে শয়তানী করবে। গুড়ের গন্ধে পিঁপড়ে সার দিয়ে এলো খুঁটি বেয়ে। দুই জন ক্রেতা দোকানে কেনা কাটা করতে আসল। একজন খাঁটির কাছে দাঁড়িয়েছে। তার গায়ে লাল পিঁপড়া দিল কামড়। পিঁপড়ার কামড়ে লাফিয়ে উঠে অন্য ক্রেতার উপর সে পরে গেলো। অন্য ক্রেতার হাতে ছিল একটি পাত্র সেটা গেলো ভেঙ্গে। দুজনে মারামারি শুরু হলো। তাদের আত্মিয় স্বজন বন্ধু পাড়া প্রতিবেশী সবাই এসে দু পক্ষ হয়ে মারামারিতে যেগ দিল। পুরো গ্রাম ছারখার খানিক সময়ে।
সদস্যপদ নিয়ে আর চিন্তা রইল না শয়তানের চেলার। কোথায় যে কে গুড় লাগিয়ে দেয় আর পিঁপড়া এসে কামড় দেয় আর সব ছারখার হয়ে যায়। এই চিন্তাটা মাঝে মাঝে পিছু ছাড়ে না।
আমার কী! আমি তো বেশ আছি বহু দূরের পৃথিবীতে। খাওয়া পড়া আনন্দ আর বিলাশ সব জড়িয়ে থাকার পরও কেন যে পুড়া মুখি আমাকে খোঁচায়? অস্থির লাগে। মাতৃভূমির ঋণ কি একেই বলে?
বাংলাদেশ সময়: ০:০৪:২৯ ৩৯৪ বার পঠিত