বঙ্গ-নিউজ ডেস্কঃ চাইলে সাংসদেরা লুঙ্গি পরে জাতীয় সংসদেও যেতে পারেন। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর স্থাপত্যশৈলী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে লুঙ্গি পরে অধিবেশনে যোগ দেওয়ায় আইনি কোনো বাধা নেই। অথচ অভিজাত বলে পরিচিত রাজধানীর বারিধারা এলাকায় লুঙ্গি পরা রিকশাচালকদের চলাচলে বাধা দেওয়া এবং এ-সংক্রান্ত আদালতের নেওয়া পদক্ষেপের সংবাদ জেনেছি সবাই।ইতিমধ্যে প্রতিবাদী কিছু তরুণ লুঙ্গি পরে বারিধারা এলাকায় সাইকেল চালানোর উদ্যোগ নিলে
তাঁরাও বাধার সম্মুখীন হন দারোয়ান ও পুলিশের। তরুণদের মতে, বারিধারা সোসাইটির হর্তাকর্তাদের পূর্বপুরুষেরা লুঙ্গি পরেই চাকরি-বাকরি ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন। বাসায় এখনো সবাই লুঙ্গি পরেন।
এসব তথ্য ও খবর শোনার পর মনে হলো, বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক কী, তা জেনে নিই। অনেকের কাছে প্রশ্ন রাখলেও সুনির্দিষ্ট উত্তর কেউ দিতে পারেননি। কারণ, জাতীয় পোশাক সুনির্দিষ্ট করা নেই। তবে লুঙ্গি নিয়ে যা জানতে পেরেছি, তা একটু বলে নিই।
মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর লুঙ্গির কথা আমরা সবাই জানি। আর্থিকভাবে সচ্ছল না হলেও ভাসানী অসামাজিক ছিলেন, এমন কথা কেউ বলতে পারবেন না। লুঙ্গির আদি উত্পত্তিস্থল সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, কেনিয়া, ইথিওপিয়াসহ আরও কোনো কোনো দেশে লুঙ্গি ব্যাপক ব্যবহূত। জাপানে লুঙ্গি একটা উত্সবের পোশাক। দক্ষিণ ভারতের কোথাও লুঙ্গিকে মুন্ডা, কাইলি ও সারং বলা হয়। মিয়ানমারে বার্মিজ ভাষায় লুঙ্গিকে লোঙ্গাই বলে ডাকা হয়। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায়ও লুঙ্গিকে ‘সারং’ বলে, ইয়েমেন-সোমালিরা বলে ‘মাআউইস’। সোমালিয়ায় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ জনতা-সবাই অফিস সময়ের বাইরে লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়ান। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে, এঁরা লুঙ্গির সঙ্গে বেল্ট পরেন। ইন্দোনেশিয়ান-মালয়েশিয়ানরা লুঙ্গির মধ্যে জামা ইন করে পরেন। ওপরে বেল্ট থাকে।
লুঙ্গির উত্পত্তি যেখানেই হোক না কেন, লুঙ্গিকে আমরা আত্তীকরণ করেছি বিভিন্ন সংগত কারণে। যেমন আরামদায়ক, সহজেই বায়ু চলাচল উপযোগী, দামও সাধারণের সাধ্যের মধ্যে। সহজে খোলা বা পরার সুবিধা তো রয়েছেই।
আমার জানামতে, কোনো জাতীয় ‘জিনিস’ই নির্ভেজালভাবে বাংলাদেশের নয়। যেমন ইলিশ, শাপলা, কাঁঠাল, দোয়েল ইত্যাদি অন্য কয়েকটি দেশেও পাওয়া যায়। মুরব্বিদের কাছে অবশ্য শুনেছি, আগের দিনে বাংলার মানুষ বেশি পরতেন ধুতি, শর্ট পাঞ্জাবি (’ব্যাপারী পাঞ্জাবি’ নামে যেটা পরিচিত, দুই পাশে আর বুকে পাঞ্জাবির মতো পকেট), হাতাকাটা ফতুয়া ও ঢোলা পাজামা। মূল কম্বিনেশন ছিল পাজামার সঙ্গে ব্যাপারী পাঞ্জাবি আর ধুতির সঙ্গে ব্যাপারী পাঞ্জাবি ও হাতাকাটা ফতুয়া দুটোই।
এ লেখার মূল প্রসঙ্গে ফিরি, জাতীয় সংসদে লুঙ্গি পরে যেতে কোনো বাধা নেই। ব্যক্তিগত কৌতূহল থেকে কথা বলি সাংসদদের কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, নিকট অতীতে কাউকে লুঙ্গি পরে সংসদ অধিবেশনে যোগ দিতে দেখেননি। স্বাধীনতার পর পর কয়েক বছর অনেক সাংসদকে লুঙ্গি পরে অধিবেশনে যোগ দিতে দেখা গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন তাঁরা।
১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাচিত সাংসদ যশোরের খালেদুর রহমান টিটো একটা চমত্কার তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি কাউকে দেখিনি লুঙ্গি পরে অধিবেশনে যেতে। আইনি কোনো বাধাও নেই। তবে ১৯৮৬ সালে যিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ছিলেন, তিনি লুঙ্গি পরেই সেখানে অধিবেশনে যোগ দিতেন।’
১৯৯১ সালের ১ আগস্টের ‘দৈনিক বাংলা’র খবরে জানা যায়, ওই সময়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি জাতিসংঘের মহাসচিব পেরেজ দ্য কুয়েলারের সঙ্গে প্রথম দিন লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি পরে দেখা করতে গিয়েছিলেন।
১৯৭৩ থেকে ৭৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবর রহমানের আমলে ঝালকাঠি সদর ও নলছিটি উপজেলা নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগের সাংসদ ছিলেন আবদুল মকিম। শুনেছি, বঙ্গবন্ধু সংসদ অধিবেশনে লুঙ্গি পরিহারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক হলেও শেষ মুহূর্তে আবদুল মকিম বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘মুই (আমি) ঠোঙ্গার (পাজামা) মধ্যে হানতে (ঢুকতে) পারমু না। আপনি আইন-ফাইন যা করেন, ওসব হবে না।’ বাতিল হয় সংসদে লুঙ্গি বন্ধের উদ্যোগ। জানা গেছে, প্রয়াত মকিমের মতামতের সমর্থক ছিলেন ঢাকার আরও কয়েকজন সাংসদ।
সবশেষে একটা দাবি উত্থাপন করতে চাই, লুঙ্গি ও ফতুয়া অথবা লুঙ্গি ও ব্যাপারী পাঞ্জাবিকে বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হোক।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:০৫:৩৬ ৫৯৬ বার পঠিত