বঙ্গ-নিউজঃবর্তমানে ইউক্রেনকে ঘিরে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় জোট যেভাবে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে নেমেছে তাতে আবারও শীতল যুদ্ধের অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন।
তবে শব্দযুগলের প্রত্যাবর্তন সত্ত্বেও মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর থেকে শীতল যুদ্ধের রাজনৈতিক ও বাস্তব পটভূমি তাৎপর্যপূর্ণভাবে বদলে গেছে।
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আবার ‘শীতল যুদ্ধ’ শব্দযুগল পুনরুজ্জীবিত হয়েছে যখন ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট আরো ঘনীভূত হয়েছে। রাশিয়ার সাথে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির ফলে এই মুহূর্তে সর্বাত্মক যুদ্ধ আপাতত বন্ধ থাকলেও এ এলাকায় শান্তি প্রক্রিয়া মূলত ভঙ্গুর এবং খুব তাড়াতাড়ি যে এ সংকটের সমাধান হবে তেমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
একদিকে পশ্চিমা জাতিগুলো এবং অন্যদিকে রাশিয়া অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে একে অপরের উপর আঘাত হানছে। আর মস্কো এ বিরোধকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে এই বলে যে, দেশটি তার বিশাল ভূ-খণ্ডের আকাশপথকে ইউরোপীয় বিমানের জন্য বন্ধ করে দেবে।
এদিকে, ইউক্রেন রাশিয়ার সীমান্ত বরাবর একটি ১,০০০ মাইল দীর্ঘ দেওয়াল নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। এমনকি ইতোমধ্যে এ দেওয়াল নির্মাণের ঘোষণা করা হয়েছে যা ইউক্রেনের নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ফেসবুক পেজে লিখেছে।
স্পষ্টত শীতল যুদ্ধের অনেক কিছুই বদলে গেছে। এটা সবারই জানা যে, শীতল যুদ্ধ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া এবং তাদের মিত্রদের মাঝে রাজনৈতিক ও সামরিক টানাপোড়েনমূলক অবস্থা।
এর সময়কাল ছিল মোটামুটিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। এটাকে শীতল যুদ্ধ বা ঠাণ্ডা যুদ্ধ বলা হয় এ কারণে যে, এ দুইপক্ষের মধ্যে সরাসরি বড় আকারের কোনো যুদ্ধ ছিল না, যদিও সে সময় কোরিয়া, ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানে বড় ধরনের আঞ্চলিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল যে যুদ্ধগুলোতে এ দুই পরাশক্তি সমর্থন করেছিল।
শীতল যুদ্ধের কারণ মূলত দেশ দুটির গভীর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতক মতাদর্শের ভিন্নতা। একদিকে, এক দল বিশিষ্ট মার্কিস্ট-লেনিনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্র। অপরদিকে, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার পুঁজিতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
এ দুই রাষ্ট্র কখনোই সরাসরি কোনো সশস্ত্র যুদ্ধে নিযুক্ত হয়নি কিন্তু তারা প্রত্যেকেই পরমাণু অস্ত্র ভিত্তিক সর্বাত্মক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
দুই পক্ষেরই পরমাণু অস্ত্র ছিল। কিন্তু কেউই সেটা ব্যবহার করেনি এ কারণে যে এমন আক্রমণে আক্রমণকারীর অস্তিত্ত্বই হুমকির মুখে পড়বে। দুই পক্ষই পরমাণু অস্ত্রের মজুতকরণের পাশাপাশি প্রচলিত সামরিক শক্তির উন্নয়ন এবং সারা বিশ্বে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে আধিপত্য বিস্তারের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে।
শীতল যুদ্ধ ছিল মূলত এ পরাশক্তির মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। আর এর মূলে ছিল একের বিরুদ্ধে অন্যের প্রচারণা ও গোয়েন্দাগিরি এবং মহাশূন্য অভিযানের মতো প্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতা।
এ শব্দযুগলটি জনপ্রিয় হয়েছিল ১৯৪৭ সালে যখন সাংবাদিক ওয়ালটার লিপম্যান ‘দ্য কোল্ড ওয়ার’ শিরোনামে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। যদিও তখন খ্যাতনামা লেখক জর্জ অরওয়েলসহ আরো অনেকেই শব্দযুগলটি ব্যবহার করেছিলেন।
সাংবাদিক ওয়ালটার লিখেছিলেন, পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী একটি দেশ এমন একটি দেশ হবে যা একই সময়ে অপরাজেয় এবং দেশটি তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে স্থায়ীভাবে একটি শীতল যুদ্ধাবস্থার ভিতরে থাকবে।
রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরমাণু অস্ত্রের সক্ষমতা বজায় রেখে আসছে যেটা সব সময় এ পরাশক্তির মধ্যে একটি টানটান উত্তেজনার উৎস হিসেবে রয়ে গেছে। ইতোমধ্যে সাইবার যুদ্ধের মতো ভয় প্রদর্শনের আধুনিক ধরণও এর সাথে যোগ হয়েছে।
তবে ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও পশ্চিমা জাতিগুলোর মধ্যকার বর্তমান যে সমস্যা তাকে শীতল যুদ্ধের সাথে তুলনা করে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিস সেন্টারের একজন সিনিয়র ফেলো এবং শীতল যুদ্ধ অধ্যয়ন বিভাগের পরিচালক মার্ক ক্রেমার মন্তব্য করেন, শীতল যুদ্ধকে আপনার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধারণার আলোকে দেখতে হবে, যেটা ছিল একটা বৈশ্বিক সামরিক ও মতাদর্শগত লড়াই।
তিনি বলেন, বর্তমানে যে লড়াই চলছে তা মূলত কোনো বৈশ্বিক সামরিক ও মতাদর্শগত লড়াই নয়। এটা শুধুমাত্র একটি আঞ্চলিক বিবাদ আর এর বিষয়টাও সম্পূর্ণ ভিন্ন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল সামরিক শক্তি বাদ দিলে রাশিয়ার বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম জনশক্তি ও বাজেট এবং ছোট সামরিক বাহিনী অবশিষ্ট রযেছে। তাছাড়া দেশটি কতিপয় পূর্ব ইউরোপীয় দেশে তার মূল সামরিক ঘাঁটি হারিয়েছে যে দেশগুলোর সবই এখন ন্যাটোর সদস্য।
শীতল যুদ্ধের ক্ষেত্রে রশিয়ার একটি মূল জিনিসের অভাবও রয়েছে। আর সেটা হচ্ছে মার্কসিস্ট মতাদর্শ যেটা সারা বিশ্বের বেশ কিছু দেশকে তার প্রভাবাধীনে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল। এমনকি ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে নিকারাগুয়া এবং ইথিওপিয়াও রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে এসেছিল। রাশিয়ার অর্থনীতি এখন অনকটাই ইউরোপীয় অর্থনীতির সাথে সমন্বিত। কারণ রাশিয়া ইউরোপের বাজারে তার প্রাকৃতিক সম্পদসহ গ্যাস, তেল ও কয়লা সবচেয়ে বেশি সরবরাহ করে।
মার্ক ক্রেমার বলেন, রাশিয়া এখনও বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন বড় ছিল, তার ধারেকাছেও রাশিয়া বর্তমানে নেই। ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বী জোট সোভিয়েত রিপাবলিক এবং তার স্যাটেলাইট রাষ্ট্রগুলোর জোট ওয়ারশ প্যাক্ট সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে দিলে ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় এবং ন্যাটো আবারও পূর্বের দিকে বিস্তৃত হয়।
ক্রেমার মন্তব্য করেন, চলমান অনেক সংকটের ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। ইউক্রেন সংকট ওই সমস্ত ফলাফলের একটি। এ ভাঙনের ফলে রাশিয়া ১৯৯১ সালে বেশ কিছু সামরিক ও পরিবহন সুবিধাও হারায় যা চলমান সংকটের ক্ষেত্রে সরাসরি সম্পর্কিত। যেমন রাশিয়া ইউক্রেনের কাছাকাছি কৃষ্ণসাগরের রণতরীর ঘাঁটি ইউক্রেনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
ক্রিমিয়ার সেভাস্তেপোলের ওই ঘাঁটিটি ১৯৯১ সালের পর স্বাধীন ইউক্রেনের একটি অংশে পরিণত হয় এবং আজও পর্যন্ত যা রাশিয়াকে লিজ নিয়ে রাখতে হয়েছে।
ক্রেমার বলেন, ২০১৪ এর মার্চ মাসে রাশিয়ার সাথে ক্রিমিয়ার একত্রীকরণের সময় হাজার হাজার সৈন্য সেভাস্তপোলের এ ঘাঁটিতে মোতায়েন করা হয় যেটা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের ‘ময়দান বিপ্লব’ শুরু হওয়ার পরপরই পদক্ষেপ নেন।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও বারাক ওবামা উভয়েই এই শব্দযুগলের ব্যবহারে বিরুদ্ধে যুক্তি দেখালেও এক দশক ধরেই এটি নিয়ে বাগাড়ম্বর ও উত্তেজনা চলছে।
মস্কোভিত্তিক সামরিক শিল্প সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার অব স্ট্রাটেজিস অ্যান্ড টেকনোলজিসের বিশ্লেষক ভাসিলি কাশিন বলেন, ‘আজকের সংঘাতের প্রকৃতি ভিন্নতর।’
‘এটা অনেকাংশে ঊনিশ শতকের বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যকার সংঘাতের মতই (যখন মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাশিয়া ও ব্রিটেন সাম্রাজ্যবাদী সংগ্রামে লিপ্ত ছিল)। এটা হচ্ছে অনেকটা উদীয়মান শক্তি চীন ও রাশিয়ার যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য রুখে দেবার প্রচেষ্টার মত ব্যাপার। আমার মনে হয় আমরা এখন আমাদের সম্পর্কের কঠিন সময়ের শুরুতে রয়েছি’, বলছিলেন কাশিন।
রাশিয়ার নেতারা এমনকি এও বলছেন, তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমাদের অবরোধ শাপে বর হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তারা বলছেন, চীনের তিয়ানআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীদের গণহত্যার পর অবরোধ আরোপ করা হলে চূড়ান্ত বিচারে দেশটি আরো শক্তিশালী হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে রাশিয়ার ওপর ইউরোপ নতুন করে অবরোধ আরোপ করার পর তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবে মিত্রদেশগুলোর নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন পুতিন। এটাকে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের পাল্টা বৈঠক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে যেখানে চীন, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার নেতারা অংশ নেবেন।
কাশিন বলেন, ইউক্রেন নিয়ে বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার সাথে ইউরোপের তুলনায় এশিয়ার সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। অনেকে মনে করছেন, রাশিয়াকে একঘরে করার যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টার ফলে রাশিয়া চীনের সাথে জোট গড়তে পারে।
তবে ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয় স্টাইলে শীতল যুদ্ধ ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি খাতের ওপর অবরোধ আরোপ করেছে ইউরোপ। এই শীতে রাশিয়া ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলে কী করণীয় তা নিয়ে জরুরি পরিকল্পনা করছে ইউরোপ।
এর বিপরীতে রাশিয়া তার আকাশসীমায় পশ্চিমা বিমানসংস্থার বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করতে পারে। রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, এটা করা হলে অনেক সংকটাপন্ন বিমান সংস্থাই দেউলিয়া হয়ে যাবে (সম্ভবত দীর্ঘপথ ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছাতে বাড়তি ব্যয়ের কারণে)।
এখনো পৃথিবীর আবাসিক এলাকার আট ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ৬৫ লাখ বর্গমাইল এলাকা রাশিয়ার অধীনে। রাশিয়া আরো বহুমুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মধ্যে যেমন মস্কোর চারটি ম্যাকডোনাল্ড রেস্তোরা বন্ধ করা রয়েছে তেমনি আছে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর র্যাপিড অ্যাকশন ফোর্স মোতায়েনের জবাবে রাশিয়ার নতুন পরমাণু অস্ত্রের উন্নয়ন।
বছর ধরে উত্তেজনা শুধু বেড়েছেই। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিভাগের এমিরিটাস অধ্যাপক এবং ‘দা মিথ অব দা স্ট্রং লিডার’ এবং ‘দা রাইজ অ্যান্ড ফল অব কমিউনিজম’ গ্রন্থের লেখক আর্চি ব্রাউন বলছিলেন, এর একটা কারণ ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ।
তিনি বলেন, ‘এখন যদি ওয়ারশ চুক্তি বলবৎ থাকতো এবং কানাডা অথবা মেক্সিকো তাতে যোগদানের চিন্তাভাবনা করতো তাহলে ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া কী হতো তা একবার ভেবে দেখুন তো।’
ব্রাউন বলছেন, এটাকে দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ বলাটা অতিরঞ্জন, যদিও এ ঘটনা সত্যিকার শীতল যুদ্ধের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪:৩৫:৩৬ ৩৮৭ বার পঠিত