বঙ্গ-নিউজ ডেস্কঃ সেই ছোট বেলার কথা, আমরা তখন থাকি সীমান্তবর্তী ছোট্ট একটি গ্রাম রহনপুরে। আমাদের একটা সাদা-কালো ১৭ ইঞ্চি নিক্কন টিভি ছিলো, যেটাতে শুধু মাত্র বিটিভি আর ভারতীয় দূরদর্শন আসতো। ইন্ডিয়া কাছে হওয়ায় দূরদর্শন ভালো আসলেও বিটিভি দেখতে খুব ঝামেলা হতো! ছাদের উপর অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝির ঝির ছবিকে পরিষ্কার করতে হতো। আমার বাবা অ্যান্টেনার বাঁশ ঘুরাতেন আর আমি জানালা দিয়ে চিৎকার করে জানাতাম পরিষ্কার আসছে কিনা। বাবার সাথে ছোট বেলা থেকেই সম্পর্কটা অনেকটা বন্ধুর মতো। আমার চিন্তা-চেতনা-অনুভূতির ভীতটা বাবাই গড়ে দিয়েছেন। প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরেই বাবা টিভি নিয়ে বসে যেত আর ভালো কিছু হলেই আমাকে পড়ার টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে দেখাতো। সপ্তাহের অন্যান্য দিন গুলোতে বাবা ছাড়া টিভির সেরকম কোন দর্শক না থাকলেও শুক্রবারের দিন দর্শকের অভাব হতো না! ৩টা বাজলেই টিভির সামনে পার্টি পেড়ে, বিছানায়, চেয়ারে দর্শক ভর্তি! কারনতো আপনারাও জানেন! আধা ঘন্টা সময় বরাদ্দ রাখা হতো অ্যান্টেনা ঘুরিয়ে ছবি পরিষ্কার করার জন্য! আর সেই সুযোগে সবার অলক্ষ্যে আমি ব্যাট-বল নিয়ে পগাড়পার!তো এক শুক্রবার দুপুরে নামাজ শেষে খাওয়ার টেবিলে বাবা খেলতে যেতে না করলেন। বললেন একসাথে বসে সিনেমা দেখতে হবে। বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিনেমা। খেতে খেতে নবাবের বীরত্ব, মীর জাফরের বেঈমানী, ইংরেজদের অত্যাচারের কথা বললেন। শুনে সিনেমা দেখার প্রতি বেশ আগ্রহ জন্মালো। বহু কষ্টে খেলতে যাওয়ার লোভটা সংবরন করে বসে গেলাম সিনেমা দেখতে। “নবাব সিরাজউদ্দৌলা”, দীর্ঘ বিজ্ঞাপন বিরতী তখন কিছুই মনে হতো না! শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে নবাবের প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ জন্মে গেল! মনে হচ্ছিলো যেন সত্যি সত্যি নবাব দেখছি! নবাবের বেশ-ভূষা, সৌর্য, সাহস, ভরাট কন্ঠ কিশোর মনের মধ্যে একটা গাঢ় ছাপ ফেললো। লম্বা কোন কিছু পেলেই সেটা হাতে তলোয়ারের মতো ধরে সিনেমার ডায়লগ বলতাম, ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মহান অধিপতি আমি…….!’ অদৃশ্য মীর জাফরকে মারার জন্য বার বার লাফ দিয়ে দিয়ে তেড়ে উঠতাম! স্বপ্নেও ইংরেজ নিধন করতে ছাড়তাম না!
আমার মতো এরকম শত শত কিশোরের মনে নবাব সিরাজউদ্দৌলার চিত্র এঁকে দিয়েছিলো যে ব্যাক্তিটি তার নাম আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কীর্তিমান এবং শক্তিমান অভিনেতা “বাংলার মুকুটহীন নবাব”। ‘বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মহান অধিপতি আমি, দাদু তুমি না বলেছিলে আমাদের এই বাংলায় বেনিয়া ইংরেজদের স্থান নেই। অথচ তোমারই অনুগ্রহে বড় হওয়া জগৎশ্রেষ্ঠ রায়দুর্লভ, উর্মিচাঁদ আর মির্জাফররা বেনিয়া ইংরেজদের সঙ্গে বাংলা দখল করার ষড়যন্ত্র করছে’ ইতিহাসের এমন কঠিন সংলাপ শুধুমাত্র যেন তার কণ্ঠেই মানায়।
আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৩১ সালের ৬ নভেম্বর জামালপুর জেলার সরুলিয়া গ্রামে। তার পিতার নাম নজির হোসেন ও মায়ের নাম সাঈদা খাতুন। নজির-সাঈদা দম্পতির তৃতীয় সন্তান আনোয়ার হোসেন।১৯৫১ সালে তিনি জামালপুর স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে ভর্তি হন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে। স্কুল জীবনে প্রথম অভিনয় করেন আসকার ইবনে সাইকের পদক্ষেপ নাটকে। ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং নাসিমা খানমকে বিয়ে করেন।
ষাটের দশকে অভিষিক্ত হওয়া বাংলাদেশের অভিনেতাদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা তিনি। ১৯৫৮ সালে চিত্রায়িত ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে অভিনয় জীবনে আসেন বাংলার নবাব। ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’, ‘লাঠিয়াল’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ভাত দে’সহ পাঁচ শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বাচসাস, পাকিস্তানের নিগারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন গুণী এ অভিনয়শিল্পী। ‘লাঠিয়াল’ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। পরে আরও দুবার তিনি এ সম্মানে ভূষিত হন। ২০১০ সালে চ্যানেল আই চলচ্চিত্র মেলায় মুকুটহীন নবাব আনোয়ার হোসেনকে আজীবন সম্মননা দেয়া হয়। এ ছাড়া ২০১১ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান আসর থেকে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন এই গুণী শিল্পী। বাংলা চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৫ সালে একুশে পদকও পান তিনি।
তার জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে কাঁচের দেয়াল (১৯৬৩), বন্ধন (১৯৬৪), জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), রংবাজ (১৯৭৩), ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), রুপালী সৈকতে (১৯৭৭), নয়নমণি (১৯৭৭), নাগর দোলা (১৯৭৮), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), সূর্য সংগ্রাম (১৯৭৯) ইত্যাদি।
তথ্য সূত্র: উইকিপিডিয়া,
বাংলাদেশ সময়: ১৪:১৯:৪৮ ৫৭০ বার পঠিত