বঙ্গ-নিউজঃ সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই প্রথম আল-কায়েদার জঙ্গিরা এখন ইসরাইলের দোরগোড়ায় অবস্থান করছে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে নিয়ে সব সময়ই দুশ্চিন্তায় ছিল ইহুদিবাদী ইসরাইল। কিন্তু এখন তার চেয়ে তাদের বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পবর্তসংকুল গোলান মালভূমিতে আল-কায়েদার উপস্থিতি।
ইসরাইলিদের আশঙ্কা তাদের ঘরের কাছেই বাসা বাঁধা এই জঙ্গিগোষ্ঠীর পরবর্তী টার্গেট হবেন তারা।
গাজায় ইসলামপন্থী হামাসের সাথে বিপর্যয়কর যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ইসরাইলের কাছে আরেকটি দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে গোলান মালভূমিতে আল-কায়েদার সিরিয়া শাখা নুসরা ফ্রন্টের সরব উপস্থিতি।
ফলে ইসরাইলের দক্ষিণ সীমান্তের এই অঞ্চল নিয়ে ইসরাইলিরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
গোলানে ইসরাইলিরা সিরিয়ার বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে যুদ্ধের দূরবর্তী শব্দ শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে সিরিয়া সীমান্তের কৌশলগত ক্রসিং কুনিত্রা দখল করে নেয় নুসরা ফ্রন্ট, ফ্রি সিরিয়ান আর্মিসহ আসাদ বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো।
তারা আসাদের বাহিনীকে সেখান থেকে হটিয়ে দেয় এবং সেখান থেকে জাতিসংঘের ৪৫ জন শান্তিরক্ষীকে অপহরণ করে।
এরপর এক নজিরবিহীন পরিস্থিতিরি মুখোমুখি হয় ইসরাইলিরা। তারা উপলব্ধি করতে শুরু করে যে আল-কায়েদার মত দুর্ধর্ষ জঙ্গিগোষ্ঠী এখন তাদের অবস্থানের কয়েক গজের নাগালে চলে এসেছে।
সিরিয়া নিয়ন্ত্রিত গোলান মালভূমিতে সাম্প্রতিক সহিংসতার সময় মর্টার শেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত আঙ্গুর ক্ষেতের পরিচর্যা করতে করতে গাবি কুনিয়েল নামের এক ইসরাইলি বলছিলেন, সিরিয়া সরকারও আমাদের ‘প্রিয়ভাজন’ নয়।
‘তবে কট্টরপন্থী আল-কায়েদা মুসলিম লোকদের চেয়ে সিরিয়ার সরকার এই অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করুক সেটাই চাই আমরা।’
বুধবার যখন তার সাথে কথা হয় তখন তিনি ছিলেন হামলা থেকে বাঁচার জন্য তৈরি কংক্রীটের একটি কাঠামোর পাশেই।
তিনি যখন কথা বলছিলেন তখন সীমান্তের সিরিয়ার অন্তর্ভুক্ত দূরের এলাকা থেকে ভারী মেশিনগানের গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এর আগেই সেখান থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে।
গত তিন বছর ইসরাইলিরা গোলান এলাকায় তুলনামূলকভাবে নিরাপদে ছিল।
কিন্ত এখন নুসরা ফ্রন্ট ও অন্যান্য বিদ্রোহীরা ইসরাইল ও সিরিয়ার মধ্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। সেখানে তারা ট্রাকভর্তি অস্ত্রশস্ত্র এবং কাঁধে বন্দুক নিয়ে ঘোরঘুরি করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসরাইলি সামরিক পোস্ট ও ইসরাইলি কৃষি ক্ষেত থেকে মাত্র ৫০ মিটার দূরে তাদের অবস্থান।
অনেক ইসরাইলি মনে করেন যে ইসলামি এসব কট্টরপন্থীদের তাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে চলে আসাটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র এবং তারা এটাও বিশ্বাস করেন যে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে আক্রমণ করাটা তাদের আদর্শেরই অংশ।
বাইনোকুলার দিয়ে সিরিয়ার কুনিত্রা ক্রসিংয়ের দিকে নজর দিতে দিতে ৫৬ বছর বয়সী ইয়েহিয়েল গাদিস বলছিলেন, ‘শেষ পর্যন্ত তারা যে আমাদের দিকে আসবে তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই।’
তার ৫৭ বছর বয়সী বন্ধু ইগাল বাশান বলছিলেন, ‘পুরো আরব জাহানই আমাদের ওপর চরম ক্ষুব্ধ।’
তাদের কথা বলার সময় বহু লোকের ভীড় জমে যায়।
১৯৬৭ সালে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে যুদ্ধের সময় ইসরাইল সিরিয়ার কাছ থেকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ গোলান মালভূমি দখল করে নেয়।
এরপর সে সেটিকে তার ভূখণ্ড বানিয়ে নিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একে ইসরাইলি ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এরপর ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের পর থেকে সেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হয়।
এরপর থেকে ওই অঞ্চলটি শান্ত ছিল। কিন্তু ২০১১ সালের মার্চে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হলেই আবার অশান্ত হয়ে ওঠে গোলান মালভূমি।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধে সেভাবে জড়ায়নি ইসরাইল। তবে হেজবুল্লাহর অস্ত্রের চালান সন্দেহে কয়েকবার বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরাইল।
গত বুধবার বিদ্রোহীরা গোলান মালভূমি দখল করে নেয়ার পর আশেপাশের ইসরাইলিদের সরিয়ে নেয় ইসরাইল।
ইসরাইল কর্মকর্তারা মনে করেন, এখনই বিদ্রোহীরা কোনো হুমকি না হলেও নুসরা ফ্রন্টের কট্টরপন্থী গোষ্ঠী তাদের জন্য নজিরবিহীন হুমকি সৃষ্টি করবে।
সিরিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের আল-কায়েদা ডেস্কের সাবেক প্রধান আভিভ ওরেগ বলেন, নুসরা ফ্রন্টের কাছে ইসরাইল একটি ‘বৈধ টার্গেট’। এখন যদিও তারা সিরিয়ার অভ্যন্তরে যুদ্ধে ব্যস্ত আছে তবে তাদের সিরিয়ায় আঘাত হানা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ এখন তাদের সরাসরি আঘাত হানা সুবিধা তৈরি হয়েছে।
কুনিত্রা ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নুসরা ফ্রন্ট ও অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজয়। এটা ছিল গোলান এলাকায় সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সর্বশেষ ঘাঁটি। এছাড়া দামেস্কের সাথে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল এটি।
ইসরাইলি প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের হিসেবে কুনিত্রা ক্রসিং থেকে সামান্য দূরেই গোলান এলাকায় এখন অবস্থান করছে নুসরা ফ্রন্টের যোদ্ধাসহ কয়েক হাজার সিরীয় বিদ্রোহী।
ইসরাইলের সাবেক সেনা কর্মকর্তা স্টিফেন কোহেন বলেন, গোলান এলাকায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়তে শুরু করেছে। ইসরাইল ও সিরিয়ার মধ্যে শান্তিচুক্তি বজায় রাখতে এখনো সেখানে যেসব নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন আছে তাদেরও নিজ নিজ সরকার ফিরিয়ে নেবে। এ ধরণের নিরাপত্তাহীনতায় কেউ থাকতে চাইবে না।
তিনি বলেন, আল-কায়েদার কাছে গোলানে জাতিসংঘ নিরাপত্তা বাহিনীর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়াটা ইসরাইলে জন্য একটি আঘাত।
ইসরাইলে সাবেক উপ-সেনাপ্রধান উজি ডায়ান বলেন, ‘সিরিয়ায় ভালো লোক, খারাপ লোক বলে কিছু নেই। তারা সবাই খারাপ লোক, খুবই খারাপ লোক এবং চরম খারাপ লোক।’
সূত্র: এপি
বাংলাদেশ সময়: ১০:২৫:৫২ ৩৫১ বার পঠিত