ডেস্কঃরাজধানীর ভাঙাচোরা, খানাখন্দকে পরিণত রাস্তাঘাট সামান্য বৃষ্টিতেই এখন দগদগে ক্ষত নিয়ে বেরিয়ে পড়ছে। প্রধান প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে শাখা রোড, অলিগলি, রাস্তাঘাটেরও অভিন্ন চেহারা। বছরের পর বছর ধরে মেরামত ও সংস্কারহীন অবস্থায় চাষাবাদের জমির আকৃতি নিয়ে পড়ে আছে। সেসব রাস্তায় পায়ে হেঁটে চলাও কষ্টকর- বাস, মিনিবাস, প্রাইভেটকার, সিএনজি, রিকশা সবই চলে খুঁড়িয়ে। প্রায়ই পানিভর্তি খানাখন্দকে চলন্ত যানবাহনের চাকা আটকে পড়ছে, দুর্ঘটনা ঘটছে। আরোহীসহ উল্টে যাচ্ছে রিকশা-ভ্যান।
রাজধানীর অভিজাত এলাকা উত্তরা মডেল টাউনের বিভিন্ন রাস্তা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, তেজগাঁও, ফার্মগেট, কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা ও মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।রাজধানীর সড়কে প্রায় সারা বছরই চলে গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ লাইনের খোঁড়াখুঁড়ি। এসব খোঁড়াখুঁড়ির পর সড়ক সারাতে প্রায়ই নেওয়া হয় দীর্ঘ সময়। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর যানজটের পেছনে সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা অনেকাংশে দায়ী। ইদানীংকালে নগরবাসীর পথের ভোগান্তি বাড়িয়েছে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের ধীরগতি। ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের জন্য মগবাজার, ইস্কাটন, মৌচাক, এফডিসির সামনের সড়ক, সাতরাস্তার মোড়, বাংলামোটর, সায়েদাবাদ ও যাত্রাবাড়ী এলাকার সড়কগুলোতে চলাচলে মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। নির্মাণকাজের কারণে এমনিতেই সড়কের একটি বড় অংশ যান চলাচলে ব্যবহৃত হতে পারছে না।
জায়গায় জায়গায় রাস্তা খুঁড়ে নির্মাণসামগ্রী রাখার ফলে বাকি অংশও সংকুচিত হয়ে গেছে। রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় মাঝে মধ্যেই আটকে থাকছে বাস। একে তো সময় বেশি লাগছে, তার ওপর কাদায় নাকাল হতে হচ্ছে পথচারী যানবাহনের যাত্রী সবাইকেই। ব্যস্ততম সড়কটির কয়েক কিলোমিটার জুড়ে কাটাকাটি, মাটি উত্তোলন করে স্থানে স্থানে ঢিবি বানানো, নির্মাণ সামগ্রী যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখায় বেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিপাতে সেখানকার অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। মৌচাক-মগবাজার-ইস্কাটন পর্যন্ত সড়কটি কাদা, পানি, বর্জ্যে মিলেমিশে পিচ্ছিল সরোবরে পরিণত হয়। ওই এলাকায় চলাচলকারী যাত্রীসহ বাসিন্দারা গত তিন বছর ধরেই ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি ছাড়াও অনেক সড়কের স্থানে স্থানে কার্পেটিং, পাথরকুচি ও ইট-খোয়া উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। এতে সড়কগুলো চলাচলের অনুপযোগী হওয়ার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত ঝুঁকি, বিড়ম্বনা ও সীমাহীন কষ্ট-দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৃষ্টির মৌসুম চলায় এসব সড়কের অবস্থা আরও ভয়াবহ।
রাজধানীর পূর্বাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ডেমরা, কদমতলী, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, মুগদা ও সবুজবাগ এলাকার বেশিরভাগ রাস্তা জলাবদ্ধতায় আটকে রয়েছে। কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতেই রাস্তাগুলো পানিতে ডুবে যায়, নিচু এলাকার বাড়িঘরে সামান্য পানি ঢুকে পড়ে। ওই এলাকায় শুধু অলিগলির রাস্তা নয়, প্রধান সড়কে চলাচল করাও কষ্টকর। একই অবস্থা মিরপুরের কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বাড্ডাতেও। বেশিরভাগ সড়ক ও গলিপথে সামান্য বৃষ্টিতেই সীমাহীন দুর্ভোগের সৃষ্টি করে। গেন্ডারিয়া এলাকায় প্রত্যেকটি রাস্তা ভাঙাচোরা ও নোংরা। রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন চলছে ঝুঁকি নিয়ে।
রামপুরা এলাকার কোনো রাস্তায় আর পা ফেলার উপায় নেই। সামান্য বৃষ্টিপাতের পানি আর ভাঙাচুরা, খানাখন্দক মিলেমিশে প্রতিটি রাস্তার অবস্থা ভয়ঙ্কর। বৌবাজারসহ আশপাশের এলাকা দীর্ঘদিন চলাচলের অযোগ্য। অভিজাত এলাকা খ্যাত গুলশান-বনানীর রাস্তাগুলো দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে বেহাল। একই সঙ্গে আশপাশের নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের আবর্জনা রাস্তার এখানে সেখানে টিলার সৃষ্টি করেছে। বৃষ্টিতে সেসব আবর্জনা, কাদা-পানিতে গোটা সড়কই মাখামাখি অবস্থায় আছে। কামরাঙ্গীরচর ভাঙ্গাপুল এলাকার বাসিন্দারা জানান, কামরাঙ্গীরচর এলাকার রাস্তাঘাট দিয়ে চলাচল এখন বিপজ্জনক।
এক কিলোমিটার পথ পেরোতে দুই-তিন বার রিকশা থেকে নেমে যেতে হয়। তাছাড়া রিকশা উল্টে দুর্ঘটনা সেখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। মিরপুর মাজার রোড ও গাবতলীর বিভিন্ন স্থানেও পানি জমে থাকতে দেখা যায়। ভাঙাচোরা খানাখন্দ ও এক হাঁটু পানির কারণে ধানমন্ডির জিগাতলা থেকে হাজারীবাগ সড়কে রিকশাসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকে। সামান্য বৃষ্টিপাতেই শান্তিনগরের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা, খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচ থেকে রাজারবাগ হয়ে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত রাস্তাও পানির নিচে তলিয়ে থাকে। শহীদবাগের অলিগলি ডুবে যায় এক কোমর পানির নিচে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নীতিমালা অনুযায়ী কোনো সড়কের খনন করার প্রয়োজন দেখা দিলে সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে তা শেষ করতে হবে। আর বর্ষা মৌসুমের আগেই সব সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি শেষ করতে হবে। খোঁড়াখুঁড়িকৃত সড়ক জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করার কথা। কিন্তু কাগজে-কলমে এমন নিয়মকানুন থাকলেও বাস্তব চিত্র তার উল্টো। মালিবাগ, রামপুরা, বাড্ডা, নতুনবাজার, মিরপুরের অনেক রাস্তা কেটে গ্যাস বা ওয়াসার কাজ করা হলেও সেসব রাস্তা আর মেরামত হয়নি।
মেরামতের বদলে ইট-সুরকির ঢিবি ফেলে রাস্তাকে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। মিরপুর পল্লবীর ৭ নম্বর সেকশন এলাকায় ৫-৬ মাস সময় নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি চালানো হয়, কিন্তু আড়াই মাসেও রাস্তা মেরামত করা হয়নি। রাজধানীর মোট রাস্তা ২ হাজার ২৮৯ দশমিক ৬৯ কিলোমিটার। গত পাঁচ বছরেও এসব রাস্তায় বড় ধরনের কোনো মেরামত-সংস্কারের কাজ চালানো হয়নি। প্রধান কয়েকটি সড়ক ছাড়া বেশিরভাগ রাস্তা ও গলিপথ এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। অনেকদিন আগে এই দুর্দশার শুরু। বৃষ্টির পানি পেয়ে সে দুর্দশা আরও চরমে উঠেছে। ডেমরার স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ছোট রাস্তা তার মধ্যে একটু বৃষ্টি হলে এ সড়কের দুই পাশে পানি জমে যায়। রাস্তায় গর্ত থাকার কারণে গাড়ি আস্তে চলে। ফলে যানজট থেকেই যায়। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে ভাঙাচোরা অংশে ইট ও বালি দিয়ে ভরাট করা হলে বৃষ্টির পানিতে তা ধুয়ে যায়।
ফলে একদিন পরই রাস্তা তার পূর্বের চেহারায় ফিরে আসে। ‘ডিসিসির দুই অংশেই অল্প সময়ের জন্য প্রশাসক দায়িত্ব পান। সিটি করপোরেশন ভাগ করার পর থেকেই দৃশ্যমান কোনো উন্নয়ন চোখে পড়ছে না।’ রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা এবং এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুল, ধানমন্ডিসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা ও গলিপথের অবস্থা ভয়ঙ্কর। মডেল টাউন হিসেবে পরিচিত উত্তরা এলাকার রাস্তাঘাটগুলো এখন অনুন্নয়নের মডেল। উত্তরা এলাকায় আজমপুর থেকে ৬ নম্বর সেক্টরে যাওয়ার পথে দিনের বেশিরভাগ সময় যানজট লেগেই থাকে। রাস্তায় ছোট ছোট অসংখ্য গর্ত। বৃষ্টি হলেই সেখানে পানি জমছে। এসব গর্তে পড়ে খাবি খেয়ে যানবাহন পার হচ্ছে। উত্তরা এলাকার ১১ ও ১২ নম্বর সেক্টরের সংযোগ সড়ক জনপথ মোড়ে রাস্তায় কার্পেটিং উঠে গেছে।
ভাঙাচোরা অবস্থা ১০ নম্বর সেক্টরের রানা ভোলা স্লুুইসগেটের সড়ক, ১৩, ৪ ও ৮ নম্বর সেক্টরের প্রতিটি সড়কের। জলাবদ্ধতার ব্যাপারে ডিসিসির (দক্ষিণ) অতিরিক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক কুদরতউল্লা খুদার বক্তব্য হলো, জলাবদ্ধতা শুধু ডিসিসির কারণেই হচ্ছে না, অনেক স্থানে ওয়াসার বড় ড্রেন লাইন বন্ধ হওয়ায় এবং নতুন নতুন স্থাপনার কারণে পাইপলাইন বন্ধ হয়ে পানি জমে। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ডিসিসি দক্ষিণের প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, খুবই অল্প সংখ্যক সড়ক মেরামত করা সম্ভব হয়নি। এ বছর অনেক সড়কেই কাজ হয়েছে। বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থার রাস্তা কাটার কারণে এ সমস্যা হচ্ছে। তিনি জানান, বৃষ্টির কারণে এখন স্থায়ী সংস্কার সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে অস্থায়ীভাবে ইট-সুরকি দিয়ে রাস্তার ভাঙা অংশগুলো সংস্কারের চেষ্টা চলছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. ফারুক জলিল বলেন, বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। গুরুত্বপূর্ণ পদে ঘন ঘন রদবদল, জনবল সংকট এবং দুই অংশে বিভক্ত অফিস কাজের ক্ষেত্রে বেশকিছুটা সমস্যা তৈরি করছে। যেহেতু উত্তর সিটি করপোরেশনের যাত্রা নতুন, সে কারণে প্রথম দিকের সংকট কাটাতে আরও কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ৯:২২:১৮ ৫২৬ বার পঠিত