বঙ্গ-নিউজঃ বেসরকারি খাতের জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সঙ্গে সরকারের কোনো বিরোধ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘সরকার ও বায়রা এক ও অভিন্ন। একে অন্যের পরিপূরক। এখানে কেউ কাউকে প্রতিপক্ষ ভাবা ঠিক হবে না। কারো মধ্যে এ ধরনের মানসিকতা থাকলে তা শুরুতেই বাদ দিতে হবে।’বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেনে লেডিস ক্লাব মিলনায়তনে বেসরকারিভাবে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। জনশক্তি রপ্তানি এবং বাজার সম্প্রসারণ বিষয়ে মতবিনিময়ের জন্য এ সভার আয়োজন করা হয়।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে কোনো ব্যবসা করছে না। বর্তমানে বিশ্বের ১৭০টি দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা যাচ্ছেন। শুধু মাত্র মালয়েশিয়াতে জি টু জি পদ্ধতির মাধ্যমের জনশক্তি পাঠানো হচ্ছে। ওই দেশের সরকারের চাহিদা অনুযায়ীই এটা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শ্রমবাজার খুলতে মালয়েশিয়া সরকারের এই চাহিদা মানা হয়েছে। এর বাইরে ১৬৯টি দেশে বেসরকারিভাবেই কর্মী যাচ্ছে। তাহলে সরকার এখানে ব্যবসা করছে কীভাবে?’
রিক্রুটিং এজেন্সিরা সরকারের প্রতিনিধি উল্লেখ করে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘সরকার যদি জনশক্তি রপ্তানি খাতে ব্যবসা করতে চাইতো তবে গত ছয় বছরে ৬০০ নতুন লাইসেন্স দেয়া হতো না। অনেক আগেই এসব এজেন্সি বন্ধ করে দেয়া হতো। সরকার কখনই জনশক্তি রপ্তানি নিয়ে ব্যবসা করতে চায় না।’
এর আগে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান লিজা ওভারসিজের পরিচালক সিরাজ মিয়া বলেন, ‘সরকার বেসরকারিভাবে মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দিলে কমপক্ষে দুই লাখ লোক পাঠানো যেত।’
জবাবে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘চাহিদা না থাকলে আপনি লোক পাঠাবেন কীভাবে? তবে অবৈধভাবে অতীতের মতো পাঠাতে পারতেন। লোকগুলোকে নিয়ে ব্রিজের নিচে রাস্তায় থাকতে দিতেন। কিন্তু চাকরি দিতে পারতেন না। আমি তো জেনে শুনে বাংলাদেশি কর্মীদের অকল্যাণ করতে পারি না।’
বিদেশি দালালের মাধ্যমে ভিসা কেনাবেচায় অভিবাসন ব্যয় বাড়ছে উল্লেখ করে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, ‘জনশক্তি রপ্তানির নামে সরকার মানুষ বিক্রির অনুমতি সরকার দিতে পারে না। একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশ বিদেশি দালালদের মাধ্যমে ভিসাকেনা বেচা করে না। দালাল ভিত্তিক ব্যবসা চলতে পারে না। বিদেশে কর্মী পাঠানোর নামে দেশের মানুষকে লাখ লাখ টাকায় বিক্রি করবেন না। তাদের সম্মানজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিন।’
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রী বলেন, ‘দালালদের বাদ দিয়ে নিজেরাই বিদেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে সম্ভাবনাময় দেশগুলোতে যান। সেখানে গিয়ে চাকরিদাতাদের সঙ্গে কথা বলুন। এজন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে। এতে অভিবাসন ব্যয় কমে আসবে। আপানারাও বেশি লাভবান হবেন। নতুন কর্মসংস্থান বাড়বে।’
শুধু মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোর অনুমতির জন্য পথ চেয়ে বসে না থেকে অন্যদেশগুলোর দিকে নজর দেয়ার আহ্বান জানিয়ে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘মালয়েশিয়ার ভূত মাথা থেকে নামান। রাশিয়া অনেক বড় দেশ। মালয়েশিয়ার চেয়ে কয়েকগুণ বড় শ্রমবাজার সে দেশে সৃষ্টি করার সুযোগ রয়েছে। আমাদের সেদিকে নজর দিতে হবে। মালয়েশিয়া ছাড়া যেকোনো দেশে লোক পাঠাতে অনুমতি দেয়া হবে।’
মালয়েশিয়াতে এখনও দুই লাখ ৬৪ হাজার কর্মী অবৈধভাবে আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো ধরনের চাহিদাপত্র ছাড়া ভিসা কিনে যাওয়ার কারণেই কর্মীরা এই দুর্ভোগের মুখে পড়েছে। এই ধরনের কাজ আর হতে দেয়া হবে না।’
অভিবাসন আইন, ২০১৩ সংশোধনের ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী বলেন, ‘শুধু ঢালাওভাবে আইনকে দোষারোপ না করে সুনির্দিষ্টভাবে আইনের ধারা ধরে কথা বলুন। বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা করুন। যদি আপনাদের কথায় যুক্তি থাকে তাহলে বিদেশে কর্মী পাঠানো বাড়াতে আইন পরিবর্তনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। কিন্তু বিদেশে লোক বিক্রির জন্য আইন পরিবর্তন কখনই করবো না।’
পৃথিবীর অন্যদেশের তুলনায় বাংলাদেশ দ্রুততম সময়ে বিদেশে শ্রমবাজার সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘ভারত ২০০ বছর ধরে বিদেশে কর্মী পাঠাচ্ছে। ফিলিপাইন ১৫০ বছর ধরে এই খাতে আছে। আমাদের দেশ বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগের কারণে ১৯৭৬ সাল থেকে জনশক্তি রপ্তানি শুরু করেছে। এই কম সময়ের মধ্যে এক কোটির বেশি জনশক্তি বিদেশে পাঠিয়েছি। এত কম সময়ের মধ্যে আর কোনো দেশ এত সফল হতে পারেনি।’
বাংলাদেশি কর্মীদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের কর্মীরা কম সময়ের মধ্যে প্রশিক্ষণ রপ্ত করতে পারে। ভারতবর্ষের অন্যদেশগুলোর কর্মীরা যেখানে একটি প্রশিক্ষণ একমাসে শেষ করে সেখানে বাংলাদেশের কর্মীরা মাত্র দুই সপ্তাহে সেই প্রশিক্ষণ রপ্ত করতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশিরা ব্যবহারিক ভাষা শিখতেও খুব কম সময় নেয়। এসব কথা আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের মুখে শুনেছি।’
বিদেশে কর্মী পাঠাতে সরকারকে অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করে দিতে ব্যবসায়ীদের দাবির ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, ‘বায়রার পক্ষ থেকে অনেক আগেই বিভিন্ন দেশে কর্মী পাঠানোর অভিবাসন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা সেটা পরিবর্তন করিনি। কিন্তু গত ছয় থেকে সাত বছরে আপনারা কেউ নির্ধারিত এ ব্যয় মেনে লোক পাঠাননি। এখন বলছেন সরকারকে ব্যয় নির্ধারণ করে দিতে। সরকার এখানে কিছুই করতে পারবে না। বিষয়টি আপনারাই ঠিক করে সরকারকে জানাবেন।’
গত ছয় বছরে প্রতিমাসে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কর্মী বিদেশ গিয়েছে জানিয়ে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এখন আমি সম্ভাবনার দিক দেখছি। এতদিনে আপনারাও (জনশক্তিরপ্তানিকারকরা) বুঝতে পেরেছেন সরকার এবং আপনারা ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত এবং একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল। সরকারও এটা বুঝতে পেরেছে। এই কথাটা বোঝাতেই আমার ছয় বছর সময় লেগেছে।’
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী বলেন, ‘ভিসা কেনা বন্ধ করতে হবে। আমরা সরকার পর্যায়ক্রমে আলোচনা করে সেদেশে ভিসা কেনাবেচা বন্ধে আইন করাতে সক্ষম হয়েছি। এখন সেখানে ভিসা কেনাবেচা ধরা পড়লে কমপক্ষে দশ বছরের কারাদ- ভোগ করতে হবে।’
একে অন্যকে দোষারোপ না করে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘বায়রার সঙ্গে সরকারের সমন্বয় গড়ে তুলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আগামী দিনে এই ধারা বজায় রাখতে হবে।’
ইউনিক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বায়রার সাবেক সভাপতি নূর আলী বলেন, ‘একটা সময় জনশক্তি রপ্তানিকারকদের আদম ব্যাপারি বলা হতো। সেখান থেকে এটা জনশক্তি রপ্তানি খাত উন্নীত করা হয়েছে। এর পেছনে বড় অবদান প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীর।’
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজেদের গুণগত মান নিশ্চিতের প্রতি জোর দিতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য ঘুরে বেড়াতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এভাবেই কাজ করেছি। সরাসরি চাকরিদাতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। বসে বসে ব্যবসা করতে চাইলে হবে না।’
নূর আলী বলেন, ‘আমাদের দালাল নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। দেশে হোক কিংবা দেশের বাইরে হোক। মন্ত্রী চান আমরা নিয়মের মধ্যে থেকে কাজ করি। নিয়ম ভাঙাকে তিনি পছন্দ করেন না। আমি সভাপতি থাকতে বায়রার যেসব সদস্য নিয়ম ভেঙেছে তাদের সংশ্লিষ্ট কমিটিতে ডেকে এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হতো। বায়রার এখনও অনেক দায়িত্ব আছে। এগুলোর প্রতি আরও নজর দিতে হবে।’
বায়রার সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে মিলেমিশে আমরা কাজ করছি। ভবিষ্যতেও করবো। সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই।’ তিনি বলেন, ‘অভিবাসী কর্মীদের নিরাপদ কর্মসংস্থানের পাশাপাশি বিদেশে শ্রম বাজার বাড়াতে আমাদেরকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য সামনের দিনগুলোতেও সরকারের আমাদের পাশে থাকতে বলে আশা করছি।’
বায়রার সভাপতি আবুল বাশারের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন প্রবাসীকল্যাণ সচিব খোন্দকার শওকত হোসেন এবং জনশক্তি রপ্তানি ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক বেগম শামছুন নাহারসহ বায়রার সদস্যরা।
- See more at: http://www.bd24live.com/article/2586/index.html#sthash.itHT1Ao5.dpuf
বাংলাদেশ সময়: ৯:৪০:৩৭ ৪১৯ বার পঠিত