সাভারে ধসেপড়া রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে হতভাগা এক নারীর গলিত লাশ উদ্ধার করা হলো। তার শরীর তল্লাশি করে পাওয়া গেল একটি মোবাইল ফোন। বন্ধ থাকা মোবাইলের সিমে সেভ করা নম্বরগুলোতে কল করে জনৈক সাগরের নম্বরে পৌঁছে যান উদ্ধারকর্মীরা। কথোপকথনের এক পর্যায়ে জানা যায়- নম্বরটি শাহিনুরের। সাগরের ফুফু সে। সাগর আরো জানান, গত ২৮ তারিখে তার ফুফুর লাশ তারা দাফন করেছেন। এখন দাফন করা লাশটির পরিচয় নিয়ে বিপাকে পড়েছে সাগরের পরিবার। লাশ দাফনের এক সপ্তাহ পরে মোবাইল ফোন আবিষ্কার করলো আসল শাহিনুরকে। তবে শাহিনুর ভেবে কার লাশ দাফন করা হয়েছিল সেটা আর নিশ্চিত করা গেল না। শাহিনুরের লাশ দাফন হয়নি সাভারে রয়েছে- তা নিশ্চিত হওয়ার পর লাশ নিতে গতকাল দুপুরেই শাহিনুরের ভাই মাসুদ রানা বগুড়া থেকে আবার সাভারের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
লাশের পরিচয় নিয়ে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর উদ্ধারকর্মীরা আইডি কার্ড ছাড়া লাশের পরিচয় নিশ্চিত করা থেকে বিরত রয়েছেন। তারা বলছেন, একজনের মোবাইল আরেকজনের কাছে থাকলেও ভোগান্তি হতে পারে। তাছাড়া একই ধরনের পোশাক আনেকেই পরতে পারেন। একারণে মোবাইল ফোন বা পোশাকের উপর নির্ভর না করে আইডি কার্ডের উপর নির্ভর করলে লাশের সঠিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া সহজ হবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা জেলা প্রশাসনের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইকরামুল হক জানান, উদ্ধার করা মরদেহের সঙ্গে মোবাইল ফোন ও পরিচয়পত্র পাওয়া গেলে ওইসব মরদেহ মাঠে নেয়া হচ্ছে। পরিচয় না মিললে তা মর্গে পাঠানো হচ্ছে। তবে ১১ দিনে কংক্রিট আর বালুতে শরীরের পোশাকের রঙ পাল্টে যাওয়ায় শুধুমাত্র পোশাক দেখে এখন আর লাশ সনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে উদ্ধার হওয়া শাহিনুরের লাশের ব্যাপারে তার ভাই মাসুদ রানার সঙ্গে কথা হয় ইত্তেফাক প্রতিবেদকের। মাসুদ জানান, গত ২৭ তারিখে তার বোন শাহিনুরের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। সে সময় লাশের চেহারা বিকৃত হওয়ায় তারা লাশের পরনের কাপড় দেখে লাশ সনাক্ত করেন এবং তিনি নিজে লাশটি বুঝে নেন। এরপর লাশটি বগুড়ার সোনাতলা থানার বালুয়া হাট ইউনিয়নে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। মাসুদ রানা আরো জানান, পয়লা বৈশাখের পোশাক ছিল দাফন করা লাশের গায়ে। তার বোনেরও একই রঙের জামা ছিল। তাই বোনের লাশ ভেবে তারা অধর চন্দ্র স্কুল মাঠ থেকে লাশটি নিয়ে যান। এখন কেউ দাবি করলে আগের লাশটি তারা দিয়ে দেবেন বলে জানান।
শাহিনুরের লাশের ব্যাপারে উদ্ধারকর্মীরা জানান, গতকাল শনিবার দুপুরে রানা প্লাজার পেছনের অংশের ধ্বংসস্ত?ূপ থেকে উদ্ধার করা হয় আরো কয়েকটি লাশ। লাশগুলো উদ্ধারের পর সনাক্তকরণের জন্য শরীরে তল্লাশি চালায় উদ্ধারকর্মীরা। মধ্য বয়সী এক নারীর বুকের জামার নিচে পাওয়া যায় একটি স্যামসাং মোবাইল ফোন। বন্ধ থাকা মোবাইলের সিম থেকে উদ্ধারকর্মীরা সেভ করা নম্বরগুলোতে কল করে শাহিনুরের পরিচয় নিশ্চিত হন। বর্তমানে তার লাশ রাখা হয়েছে অধর চন্দ্র স্কুল মাঠে।
উদ্ধারকর্মীরা জানান, প্রাথমিকভাবে জানা জানা গেছে, বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার বালুয়া হাট গ্রামের আব্দুল কুদ্দুসের মেয়ে শাহিনুর (২৫)। ছয় বছর আগে সাভারে এসে কাজ নেন রানা প্লাজার ‘ইথার টেক্স’ কারখানায়। আট বছরের মেয়ের মা শাহিনুরের স্বামী টাঙ্গাইলের একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন।
এদিকে লাশ পচা গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে সাভারের আকাশ-বাতাস। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে আরো ১৮টি লাশ। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ৫৫১। এর মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে ৪৪১ জনের মরদেহ। ১১ দিনে নয়তলা ভবনের মাত্র নবম তলা পুরোপুরি অপসারণ সম্ভব হয়েছে। গতকাল অষ্টম তলার ধ্বংসস্তূপ অপসারণের কাজ চলছিল। ভেতরে কংক্রিটের মধ্যে আরও অসংখ্য মৃতদেহ থাকার আশংকায় এখনও উদ্ধার অভিযান চলছে সতর্কতার সঙ্গে ধীর গতিতে।
রানা প্লাজার সামনে ও অধর চন্দ্র স্কুল মাঠে শোকাহত স্বজনেরা এখনো অপেক্ষা করছেন তাদের প্রিয় মানুষটির মৃতদেহ ফিরে পাওয়ার আশায়। তবে অধর চন্দ্র বিদ্যালয়ে নিখোঁজের তালিকাটি আর দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই নিখোঁজের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে এসে তালিকার খোঁজ পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়, এর আগে যে তালিকা হয়েছিল সেখানে একই ব্যক্তির নাম তিন চারবার করে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পরে তালিকা তৈরির কাজ বন্ধ রাখা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মরদেহের হিসেব ছাড়া আর কোন তালিকা তাদের কাছে নেই।
গতকাল সরেজমিনে দেখা গেছে, ধসে পড়া ভবনের সামনে দু’টি এবং পেছনে তিনটি ভারী ক্রেন দিয়ে চলছে বিরামহীন উদ্ধার অভিযান। পাশে আরও দু’টি ক্রেন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস এবং রেড ক্রিসেন্টের প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মীরা ভারী যন্ত্রের পাশাপাশি আগের মতই ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কংক্রিটের আবর্জনা সরিয়ে সতর্ক চোখে মরদেহের সন্ধান করছেন।
উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সেনা সদস্য ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, কংক্রিট অপসারণের সময় ভেতরে মৃতদেহ আছে কি-না আগে তার সন্ধান করা হচ্ছে। মৃতদেহ না থাকার বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পরই ক্রেন দিয়ে একেকটি তলার ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় গতকাল দুপুরের মধ্যে নয়তলা ভবনের নবম তলা পুরোপুরি অপসারণ করা হয়েছে। দুপুরের পর থেকে অষ্টম তলা অপসারণের কাজ শুরু হয়েছে।
ধ্বংসস্তূপ সরানোর দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর ৩ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ানের মেজর এমএম মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ধ্বংসস্তূপে মরদেহ খুঁজতে সময় লাগছে। একটি মরদেহের সন্ধান পাওয়া গেলে তা যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্ধার করতেও সময় নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা যদি নিশ্চিত হই আর কোন মরদেহ নেই, তাহলে অল্প সময়ে ধ্বংসস্তূপ সরানো সম্ভব হবে। সে ধরনের সব প্রস্তুতি ও সরঞ্জাম রয়েছে।
এদিকে ধ্বংসস্তূপ সরাতে আর কতোদিন লাগবে জানতে চাইলে উদ্ধার কাজের প্রধান সমন্বয়ক নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী জানান, ‘কতোদিনে ধ্বংসস্তূপ সরানো যাবে তা নিয়ে আমরা চিন্তা করছি না। সময় যাই লাগুক না কেন, আমরা ভেতরে থাকা মৃতদেহগুলো উদ্ধার করতে চাই।’
বাংলাদেশ সময়: ১০:৫২:২৬ ৫৯৬ বার পঠিত