ডেস্করিপোর্টঃদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাঙের ছাতার ন্যায় বিস্তৃতি লাভ করেছে ভুয়া ইউনিভার্সিটি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অনুমোদন না পেলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে সনদ-বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ কার্যক্রম। অনুমোদনভুক্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তালিকায়ও এসব প্রতিষ্ঠানের নাম নেই। তারপরও প্রশাসনের ছত্রছায়ায় নামে-বেনামে কথিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে ওঠা আউটার ক্যাম্পাসের নামে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে এ প্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড দেখে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি হওয়া হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রতারিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা না নেওয়ার পাশাপাশি কোনো দায়ভারও নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় কার্যক্রম দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক আতফুল হাই শিবলী বলেন, দেশে বৈধ এত বেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেগুলোকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছি। আর অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ধরনের নামের তালিকাও মঞ্জুরি কমিশনের হাতে নেই। আমরা এসব বিষয়ে অবগত নই।এদিকে গত ১১ জুন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের আমন্ত্রণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদরা এক বৈঠকে বসেন। বৈঠকে শিক্ষাবিদরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া না হয় সে ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। শিক্ষাবিদরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, উচ্চশিক্ষার নামে দেশে শিক্ষাবাণিজ্য রমরমা হয়ে উঠেছে। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে উচ্চশিক্ষার মান ও পরিবেশ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯২ সালে পিস ব্লেন্ড ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নামে একটি অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে উচ্চশিক্ষার নামে প্রতারণা ও সনদ বিক্রির ব্যাপক অভিযোগ ছিল। এর চেয়ারম্যান এম এন হক ভুয়া সনদ বিক্রির অভিযোগে জেলও খেটেছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং গণমাধ্যমের কারণে ওই নামে আর বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছিল না।
আশ্চর্যজনক যে, ছয় বছর পর পিস ব্লেন্ড নাম পাল্টে এম এন হক প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নামে নতুনভাবে কার্যক্রম শুরু করে। এখন দেশের ছয়টি এলাকায় সাতটি শাখা নিয়ে এই অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়টি পরিচালিত হচ্ছে। এসব শাখায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার। এম এন হকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীতে দুটি শাখায় প্রায় ৭০০, বগুড়া শাখায় ৩০০, নাটোরে ৩০০, ময়মনসিংহ শাখায় ৫০ এবং রংপুর শাখায় ২০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। তাছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের নামে ঢাকার উত্তরায়ও একটি শাখা রয়েছে। এ শাখায় প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী আছে। কিন্তু উত্তরা শাখায় বর্তমানে শিক্ষাকার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়ের এতগুলো অবৈধ শাখা চালানোর কারণ জানতে চাইলে এম এন হক বলেন, আগে তার ১৫টি শাখা ছিল। এখন কমে সাতটি হয়েছে। আর পুরান ঢাকার শাখাটি ইজারা দিতে গিয়ে বেদখল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, অনুমতি চেয়ে পাননি বলেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় চালিয়ে যাচ্ছেন এবং অনুমতির চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে সরকার মিরপুরের ঠিকানায় প্রাইম ইউনিভার্সি নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়। সেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উত্তরার বিএনএস সেন্টারে একটি ক্যাম্পাস খোলার চুক্তি করে জনৈক আবুল হোসেনের সঙ্গে। একপর্যায়ে মিরপুর অংশের কিছু ট্রাস্টিকে নিয়ে উত্তরা গ্রুপ নিজেদের আলাদা শক্তি হিসেবে দাঁড় করায়। এমনকি তারা সর্বশেষ ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী ট্রাস্টি বোর্ডও গঠন করে। এভাবে মালিকানার ওপর শক্ত দাবি নিয়ে আবির্ভূত হয় উত্তরা গ্রুপ। তারা ক্যাম্পাস ভাড়া নিয়ে বর্তমানে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়েরই মালিকানার দাবি শক্ত করে ফেলে। উভয় গ্রুপের মামলা, পাল্টা মামলায় পরিস্থিতি এতটাই জটিল ধারণ করে যে, ইউজিসি শেষ পর্যন্ত তাদের ওয়েবসাইটেও মূল মালিক কোন পক্ষ সে ঠিকানা মুছে দিয়েছে।
এ অবস্থার মধ্যেই রাজধানীর বারিধারা-কুড়িল, ফার্মগেট ও মিরপুরে ‘অ্যানেঙ্ ক্যাম্পাস’ নামে আলাদা ক্যাম্পাস খুলেছে উত্তরা গ্রুপ। তবে গত সপ্তাহে অ্যানেঙ্ ভবনের ক্যাম্পাস বন্ধ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ বিষয়টি আইনবহির্ভূত বলে জানিয়েছেন ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী। জানা যায়, ইবাইস ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক ড. জাকারিয়া লিংকন। তিনি ২০০২ সালের ৬ আগস্ট সরকার থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিয়ে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপন করে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করেন। কিন্তু ২০১১ সালের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয়টি জোরপূর্বক দখলে নেন জাকারিয়া লিংকনের ভাই কাওসার হোসেন কমেট। এরপর ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠা করা হয় একাধিক শাখা ক্যাম্পাস। সম্প্রতি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরার একটি শাখা ক্যাম্পাসের বৈধতার প্রশ্নে শিক্ষার্থী এবং মালিক পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ইবাইস ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন শাখা ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা এক হয়ে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনও করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আতফুল হাই শিবলী বলেন, মঞ্জুরি কমিশনের একটি টিমকে শিক্ষার পরিবেশ ও সিলেবাস এবং ক্যাম্পাস পর্যবেক্ষণে প্রায় ৩৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আকস্মিক ঝটিকা সফরে পাঠানো হয়েছে। যেগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে সেগুলোর বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণ করা হয়েছে। তা ছাড়া এই কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তবে কোনো অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এর শাখা বন্ধ করার ক্ষমতা ইউজিসির নেই। কমিশনের পক্ষ থেকে কিছুদিন আগেও সব জেলা প্রশাসককে অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্ছেদে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনকে হাত করে প্রতারক চক্র শিক্ষাবাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৫:১১:০৮ ৪১৬ বার পঠিত