ডেস্কনিউজঃ নারায়ণগঞ্জে বৈধ অস্ত্রের অভাব নেই, চলছে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীর নামেও লাইসেন্সকৃত রয়েছে অস্ত্রশস্ত্র। নিরাপত্তাজনিত কারণে খ্যাতনামা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামে যেমন আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স আছে, তেমনি ডজন ডজন মামলার আসামি, কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ীর নামেও নির্দ্বিধায় দেওয়া হয়েছে এ লাইসেন্স। কি মহানগর, কি গ্রাম- সর্বত্রই লাইসেন্সকৃত অস্ত্রের পাশাপাশি চলছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার।রূপগঞ্জের ছনপাড়া বস্তিতে রয়েছে অস্ত্র কেনাবেচার বড় ঘাঁটি। চিটাগাং রোডের ইয়াবা সম্রাট আমির হোসেনের আস্তানাসহ দুটি স্থান থেকে সন্ত্রাসীরা যে কোনো ধরনের অস্ত্র-গুলি ভাড়া নিতে পারেন। এসব ব্যাপারে জেলা ডিবির কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয় না। নারায়ণগঞ্জ ডিবি শুধু অপরাধীদের কাছ থেকেই মাসোহারা নেয় না, তারা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র গুনে গুনেও মাসিক মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের সর্বত্রই অস্ত্রের ঝনঝনানি। এমপি গ্রুপ, মেয়র গ্রুপ, চেয়ারম্যান গ্রুপ, মেম্বার গ্রুপ- এমন নানা নামে নানা পরিচয়ে শতাধিক গ্রুপের সহস্রাধিক ‘ভালো মানুষ’ ব্যবহার করছে আগ্নেয়াস্ত্র। শত শত ‘বৈধ অস্ত্রের’ ছড়াছড়ির মধ্যে ‘অবৈধ অস্ত্রের’ খোঁজ কে রাখে। নারায়ণগঞ্জে রাজনৈতিক সংঘাতেও অস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার দেখতে পান বাসিন্দারা। আবার মিল-কারখানায় চাঁদাবাজি করতে যাওয়া ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের আগ্নেয়াস্ত্র থেকেও গুলিবর্ষণের খবর পাওয়া যায় প্রায়ই। পান থেকে চুন খসলেই কোমর থেকে অস্ত্র বেরিয়ে আসে। জেলাজুড়ে প্রশাসনের অস্ত্র উদ্ধার অভিযান কখনোই সফলতা পায় না। এমনকি জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় বৈধ অস্ত্রগুলোও জমা পড়ে না থানায়। সরকারি আদেশ অমান্য করার জন্য কোনো বৈধ অস্ত্রধারীর লাইসেন্স বাতিল হওয়ারও নজির নেই।
নারায়ণগঞ্জ জেলায় নিজেদের ভিআইপি, সিআইপি আর নিরাপত্তাহীন ভালো মানুষ পরিচয় দিয়ে পাঁচ শতাধিক অস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়া হয়েছে। চারদলীয় জোটের শেষ সময়ে এবং আওয়ামী লীগ আমলের শেষ দুই বছরেই নেওয়া হয়েছে প্রায় ৩০০ অস্ত্রের লাইসেন্স। এসব লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী হলেই অস্ত্রের লাইসেন্স মিলেছে। নারায়ণগঞ্জে সাতজনকে অপহরণ ও হত্যা ঘটনায় প্রধান আসামি হিসেবে চিহ্নিত হোসেন চেয়ারম্যান গ্রুপের কাছেও লাইসেন্সকৃত ১১টি শটগান ও ১০টি পিস্তল-রিভলবার ছিল। ২১টি অস্ত্রের লাইসেন্স ছিল তার পরিবার-পরিজনের নামেই। এ ছাড়া তার ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বৈধ অস্ত্র ছিল অর্ধশতাধিক। ৭০ থেকে ৮০টি বৈধ অস্ত্র নিয়েই গড়ে ওঠে হোসেন চেয়ারম্যানের গ্রুপ। তার ক্যাডারদের হাতে অবৈধ অস্ত্র কতগুলো ছিল সে হিসাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও দিতে পারেননি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, হোসেন চেয়ারম্যান এলাকায় চলাফেরাকালে চারপাশে শতাধিক অস্ত্রধারীর সার্বক্ষণিক অবস্থান দেখতে পেতেন তারা। গোপনে বা চুপিসারে নয়, প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে ঘোরাফেরা করতেন দেহরক্ষীরা। নারায়ণগঞ্জে নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে গুম ও হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত প্রধান আসামি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেন ও তার অনুসারীদের ১১টি অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। গতকাল বিকেলে লাইসেন্সগুলো বাতিলের ঘোষণা দেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিয়া। নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও শ্বশুর শহীদুল ইসলামের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লাইসেন্সগুলো বাতিল করা হয় বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু এলাকার বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, এসব বৈধ অস্ত্রের বিপরীতে একেকজনের কাছে তিন-চারটি করে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। এ ছাড়া নূর হোসেনের পরিবারের সদস্যদের নামে রয়েছে আরও অন্তত ১০টি অস্ত্রের লাইসেন্স। এগুলো এখনো বহাল আছে। হোসেন চেয়ারম্যানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন হিসেবে নারী পাচার ও জুয়ার মেলা পরিচালনাকারী রহম আলীর কাছে রক্ষিত আছে ১২টিরও বেশি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। রাজধানীর কাপ্তানবাজারের ১০ নম্বর দোকানের জনৈক রোমান মিয়ার নিয়ন্ত্রণে আছে রহম আলীর অস্ত্রভাণ্ডার। শাহজাহানের অস্ত্রশস্ত্র রাখা হয় চিটাগাং রোড এলাকার ইয়াবা সম্রাট আমির হোসেনের আস্তানায়। রূপগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশাররফ বাহিনীর অস্ত্র থাকে তারই সহযোগী কাইল্যা তুহিনের কাছে। অবৈধ অস্ত্রধারীদের এমন ভাণ্ডারের অভাব নেই নারায়ণগঞ্জে। এর আগে ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে মানুষ ছিল সন্ত্রাসীদের ভয়ে তটস্থ। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, তুচ্ছ ঘটনায় প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, খুন, লুটতরাজ আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছিল বিএনপির ক্যাডারদের নিত্যদিনের কর্মসূচি। ১১ নভেম্বর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর নারায়ণগঞ্জে এক সুধী সমাবেশ করে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে জেলা থেকে সন্ত্রাস নির্মূলের ঘোষণা দেন। এর পর থেকে বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ঘোষণার পর থেকে স্থানীয় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের সঙ্গে র্যাব আর পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে ক্রসফায়ারে মারা যেতে শুরু করে একের পর এক সন্ত্রাসী। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে মাত্র ছয় দিনে তিন শীর্ষ সন্ত্রাসী ৩৭ মামলার আসামি জেলার আলোচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী ও যুবদল ক্যাডার মমিন উল্লাহ ডেভিড, আদমজীর কদমতলী এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও বিএনপি কর্মী মিনিষ্টার শাহ আলম ও যুবলীগ ক্যাডার নজরুল ইসলাম সুইট ক্রসফায়ারে মারা যান। শীর্ষ পর্যায়ের আরও অন্তত এক ডজন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী পাশর্্ববর্তী রাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আত্দরক্ষা করে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী আর অস্ত্রবাজ ক্যাডার পালিয়ে ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্যাডারদের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন গোটা জেলাবাসী। এত অস্ত্রের ছড়াছড়ি দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও রীতিমতো অবাক হন। কিন্তু শীর্ষ সন্ত্রাসীদের রেখে যাওয়া অস্ত্রভাণ্ডারকে পুঁজি করে তাদেরই অনুসারীরা আবার আগের মতোই হুঙ্কার দিচ্ছে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে। রাজনীতি-অভিজ্ঞরা মনে করছেন, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা পেশাদার অপরাধীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতায় তটস্থ হয়ে পড়েছেন নারায়ণগঞ্জবাসী। জেলায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের বিশাল অত্যাধুনিক অস্ত্রভাণ্ডার এখনো অক্ষত রয়েছে। এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জে সদ্য যোগদানকারী ড. খন্দকার মহিতউদ্দিন জানান, অবৈধ অস্ত্রধারীদের কোনোরকম ছাড় দেওয়া হবে না। জেলার সর্বত্র অবৈধ অস্ত্রবাজদের তালিকা প্রণয়ন করা আছে। শিগগিরই অভিযানে নামবে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। জেলা প্রশাসক আনিছুর রহমান বলেন, নারায়ণগঞ্জে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কোন কোন অপরাধী অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ নিশ্চিত হলেই লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কেউ কোনো ছাড় পাবে না।
বাংলাদেশ সময়: ৯:৪১:২১ ৪৭১ বার পঠিত