অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্কবাণী

Home Page » স্বাস্থ্য ও সেবা » অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সতর্কবাণী
রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০১৪



madecine.jpgবঙ্গ-নিউজ ডটকম ঢাকা: ওষুধের অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার অসুস্থতা সারিয়ে তোলার বদলে বরং আরো বেশি ক্ষতির কারণ হতে পারে। অতিরিক্ত ওষুধ সেবনের ফলে সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রভাব না পড়লেও ভবিষ্যতে দেহে এমন রোগের সংক্রমণ ঘটার সম্ভাবনা থাকে যা থেকে আর কখনো আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা নাও থাকতে পারে।

এই কারণেই বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের জনগণ বর্তমানে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। বিশেষ করে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ সেবনের কারণে দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী বর্তমানে লিভার ও কিডনির ঝুঁকিতে রয়েছে বলে একটি গবেষণায় জানা গেছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এবং চিকিৎসকদের একটি অংশ একজোট হয়ে রোগীদের উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের জন্য উৎসাহিত করছেন।

ঢাকায় অবস্থিত স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি অনুষদের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক কুমার বিশ্বজিৎ সূত্রধর গবেষণাটির সূত্র ধরে জানিয়েছেন, ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো সারা দেশের চিকিৎসকদের মধ্যে একটি অংশকে নগদ অর্থসহ নানা ধরনের ঘুষ প্রদান করেন।

প্রভাষক কুমার বিশ্বজিৎ সূত্রধর বলেন, “প্রয়োজন ছাড়াই বিভিন্ন দামি ওষুধগুলো যে মানুষ মাত্রা ছাড়িয়ে ব্যবহার করছে, তা হলো এই চিকিৎসকদের ঘুষ প্রদানেরই ফল।”

সূত্রধর এবং গবেষণার সঙ্গে জড়িত অন্যান্যরা গবেষণাটি চালিয়েছেন গ্রামাঞ্চলের ছয় হাজার রোগী ও ৫৮০ জন চিকিৎসক, গ্রামের ডাক্তার এবং চিকিৎসকদের সহকারী কম্পাউন্ডার বা ফার্মাসিস্টদের ওপর। ২০১২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দেশের বৃহত্তর দুই বিভাগ ঢাকা ও রাজশাহীর বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে গবেষণাটি চালানো হয়। আর চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি ইংল্যান্ডভিত্তিক জার্নাল ‘সায়েন্স ডোমেইন ইন্টারন্যাশনাল’-এ গবেষণাটি প্রকাশিত হয়।

সূত্রধর জানান, গবেষণাটি দেশের গ্রামাঞ্চলের সীমিত অংশে চালানো হয়েছে। কিন্তু গবেষণাটির ফলাফল প্রকৃতপক্ষে সারা দেশের পুরো গ্রামাঞ্চল তো বটেই, এমনকি বিভিন্ন শহরাঞ্চলেও অতিমাত্রায় ওষুধ সেবনের ভয়াবহ পরিস্থিতির চিত্রেরই একটি প্রতিফলন।

গবেষণায় দেখা গেছে, রোগ নির্ণয় বাধ্যতামূলক হলেও ৪৪ শতাংশ চিকিৎসক তা না করেই সাধারণ সর্দি-জ্বরের জন্য রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের পরামর্শ দেন এবং শ্বাসজনিত সংক্রমণের তীব্র সমস্যার ক্ষেত্রেও একইভাবে তারা রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে বলেন।

আর রোগীদের একটি অংশের পক্ষ থেকে নিজেদের চিকিৎসার বিষয়ে অবহেলার ব্যাপারে বলা হয়, ওষুধ গ্রহণ করতে শুরু করার পর রোগের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে কমে যেতে শুরু করলেই প্রায় ৫০ শতাংশ রোগী চিকিৎসকদের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন বন্ধ করে দেন। আর মাত্র ২৫ শতাংশ রোগী চিকিৎসকের পরামর্শ মতো অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের মাত্রা বজায় রেখে কোর্সটি সম্পূর্ণ করেন।

গবেষণায় আরো বলা হয়, রোগীদের ২৭ শতাংশই বিশ্বাস করেন যে, চিকিৎসকদের পরামর্শপত্র সবসময় অনুসরণ করা জরুরি নয়।

সূত্রধর উল্লেখ করেন, অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স অসম্পূর্ণ রেখেই ওষুধ সেবন বন্ধ করে দেয়ার অর্থ হলো ব্যাকটেরিয়াগুলো ধ্বংস না হয়ে দেহের ভেতরে রয়ে যাবে এবং পরবর্তী ধাপে আবারো দেহে আক্রমণ চালাবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যান্টিবায়োটিকের একটি ডোজও ভুলে বাদ দেন যেসব রোগী- তাদের মধ্যে মাত্র ছয় শতাংশ রোগী জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ৫১ শতাংশ রোগী পরবর্তী ডোজগুলো নিয়মিত গ্রহণ করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বনের চেষ্টা করেন, যেখানে ২৩ শতাংশ রোগী বাদ পড়া ডোজের পরবর্তী ডোজটি গ্রহণের সময় তার পরিমাণ দ্বিগুণ করে দেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই ধরনের ওষুধের অপ্রয়োজনীয় বা মাত্রা ছাড়ানো ব্যবহারের ফলে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। ফলে পরবর্তীতে রোগের ব্যাপ্তি ও তীব্রতা কয়েকগুণ বেড়ে যায় যা এমনকি বিভিন্ন ক্ষেত্রে মৃত্যুও ডেকে আনতে পারে।

আর যদি দেহে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিহত করার ক্ষমতা অব্যাহত থাকে, তাহলে রোগীর দেহে ব্যাকটেরিয়া সৃষ্ট রোগের ব্যাপ্তি ভবিষ্যতে চিকিৎসার আওতার বাইরে চলে যেতে পারে বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা।

ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) ফার্মাসির অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ বলেন, “প্রয়োজন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে তা কিডনি ও লিভারের ক্ষতির কারণ হতে পারে।”

প্যারাসিটামল জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ এবং অ্যাসপিরিনও লিভার ও কিডনিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে ক্ষতির মাত্রা আরো বেশি হয়। লিভারে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ভেঙে যায় এবং পরে তা শারীরবৃত্তিও নিয়ম অনুযায়ী কিডনির মাধ্যমে বের হয়ে আসে।

তাই কেউ যদি অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন, তাহলে এই পদ্ধতিতে লিভার ও কিডনির ক্ষতি হওয়াই যৌক্তিক ও স্বাভাবিক প্রভাব বলে জানান রহমতুল্লাহ।

তিনি আরো বলেন, “লিভার স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা প্রতিস্থাপন করতে হয়। এর খরচ ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকার মতো। আর এতেও ব্যর্থ হলে রোগীর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।”

২০০৮ সালে আমেরিকান গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিকাল অ্যাসোসিয়েশন ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণায় ইডিওসিনক্রেটিক ড্রাগ-ইনডিউসড্‌ লিভার ইনজুরি (ডিআইএলআই) বা যকৃতের অসুখের পেছনে ওষুধজনিত একক প্রভাব হিসেবে একমাত্র অ্যান্টিবায়োটিককেই দায়ী করা হয়েছে।

যকৃত বা লিভারের কাজ বন্ধ হয়ে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো এই ডিআইএলআই এবং আমেরিকায় এই ধরনের ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে যকৃত কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বায়োকেমিস্ট্রির অধ্যাপক ড. ইকবাল আরস্লান বলেন, “অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার অনেক ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। কারণ দেহে ওষুধের কার্যক্ষমতা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের সাধারণ ওষুধ যতটা প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে, তার চাইতে অনেক দ্রুতগতিতে এই ক্ষমতা গড়ে তোলে অ্যান্টিবায়োটিক।”

তবে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের জন্য তিনি বিক্রয় প্রতিনিধিদের দায়ী করে জানান, নিবন্ধিত চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথানাশক ওষুধ বিক্রি থেকে বিক্রিতাদের প্রতিহত করতে সরকারের একটি কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি অনুষদের অধ্যাপক এ বি এম ফারুক জানান, বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী- রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দেয়ার আগে চিকিৎসকদের অবশ্যই রোগের প্রকৃতি খুব ভালোভাবে জেনে নিতে হবে এবং যেসব ওষুধ গ্রহণ করতে বলা হবে রোগীদের, সেগুলো যথাসম্ভব স্বল্পমূল্যের, সুলভ এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াবিহীন হতে হবে। আর এই নির্দেশনাটি প্রায়ই অবহেলা করেন চিকিৎসকরা।

ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মহাপরিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল হোসাইন মল্লিক জানান, রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দেয়ার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চিকিৎসকদের উৎসাহিত করতে পারে।

ওষুধ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলোর চিকিৎসকদের ঘুষ দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, “এই ধরনের দুর্নীতি আপনি প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখতে পাবেন।”

এই প্রসঙ্গে বিএমএ’র মহাব্যবস্থাপক ড. ইকবাল আরসালান জানান, চিকিৎসক ছাড়াও রোগীদেরও এতটুকু শিক্ষিত ও সচেতন হতে হবে যেন তারা ওষুধের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে পারেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪:১৭:১১   ১৩৪১ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

স্বাস্থ্য ও সেবা’র আরও খবর


২০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হচ্ছে করোনা টিকার চতুর্থ ডোজ
ষাটোর্ধ্ব মানুষ আগে পাবেন করোনার টিকার চতুর্থ ডোজ : স্বাস্থ্যমন্ত্রী
কিছু লোক দেশের চিকিৎসায় আস্থা রাখতে পারে না-শেখ হাসিনা
বাড়ির আঙ্গিনাতেই আছে ওজন কমানোর উপায়
মারাত্মক আঘাত হানতে পারে সিত্রাং দেশের ১৩ জেলায়
অ্যানেন্সেফ্লাই কী? - রুমা আক্তার
পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে নৌকা ডুবে ২৪ জনের মৃত্যু
জিনগত ত্রুটির অপর নাম “ডাউন সিনড্রোম”- রুমা আক্তার
৭৫ দেশে ছড়িয়ে গেছে মাঙ্কিপক্স , সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি
আবার করোনার পাগলা ঘোড়া, এক লাফে মৃত্যু ১২!

আর্কাইভ