বঙ্গ-নিউজঃ একাত্তরে গণহত্যাসহ সাত ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তখনকার সহযোগী সংগঠন ও নেতাকর্মীদের দায়ী করে তাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের সুপারিশ করছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।সাত মাস তদন্তের পর বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী এই দলটির যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের বিষয়ে এই তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সদস্য সানাউল হক বলেন, “৩৭৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি আমরা প্রসিকিউশনের কাছে হস্তান্তর করব।”
যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সাজার পর গতবছর খোদ দলটির বিরুদ্ধে এই তদন্ত শুরু করে তদন্ত সংস্থা।
এর আগে ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন রায়ে যুদ্ধাপরাধে দল হিসেবে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে। সর্বশেষ গোলাম আযমের রায়ে জামায়াতকে একটি ‘ক্রিমিনাল সংগঠন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান খান জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামী ও তাদের তখনকার সহযোগী সংগঠনগুলো যে সারা বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছিল, তার প্রমাণ তারা তদন্তে পেয়েছেন।
“জামায়াতে ইসলামী এ পর্যন্ত চারবার নিষিদ্ধ হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের নৈরাজ্যের পেছনেও এই সংগঠন ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো রয়েছে। চিরতরে তাদের অবলুপ্তি বা নিষিদ্ধ ঘোষণা চাইব।”
জামায়াতের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন এবং একাত্তরের আল বদর, আল শামস সদস্যদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করারও আর্জি জানানো হবে বলে জানান তিনি।
জামায়াত ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে একাত্তরে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জেনেভা কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন, মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র এবং এসব অপরাধ ঠেকাতে ব্যর্থতাসহ সাত ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
এতে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামী, তাদের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ; পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা দিতে গঠিত শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী এবং জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ৪ এর ১ ও ৪ এর ২ ধারা অনুযায়ী অপরাধ করেছে।
“এসব সংগঠনের নীতি, নীতিনির্ধারক ও সব নেতাকর্মী এসব অপরাধের জন্য দায়ী।”
তদন্তকারীদের অন্যতম প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ পরে বঙ্গ-নিউজ ডটকমকে বলেন, “তদন্ত শেষ হয়েছে। এ সংগঠনের বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে বিভিন্ন ধরনের সাজা হতে পারে। সংগঠনটি নিষিদ্ধ হতে পারে, তাদের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে।”
তদন্ত সংস্থার সদস্য সানাউল হক জানান, প্রতিবেদনে মোট ৭০ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ইতিহাসবিদ, গবেষক এবং একাত্তরে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরাও রয়েছেন।
“জামায়াত সংগঠন হিসাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আলবদর, আলশামস গঠন করে এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করে। বিতর্কিত মালেক সরকারেও তারা যোগ দেয়। এই নীতি-আদর্শ নিয়ে এর বতর্মান নেতৃত্ব অথবা অন্য কেউ অন্য কোনো নামেও রাজনীতি করতে পারবে না।”
এক প্রশ্নের জবাবে সানাউল হক বলেন, অভিযোগ গঠন হলে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বকে সমন পাঠানো হবে। অতীতে যারা জামায়াতের রাজনীতি করেছেন, তারাও এ মামলা লড়তে পারেন।
“যদি কেউ ডিফেন্ড না করে, তাহলে ইন অ্যবসেনশিয়া ট্রায়াল হবে।”
প্রসিকিউশনের তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান গত বছর ১৮ অগাস্ট জামায়াতে ইসলামীর যুদ্ধাপরাধের এই তদন্ত শুরু করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনের সঙ্গে ৭ খণ্ডে ২ হাজার ২ হাজার ৩০৩ পৃষ্ঠার জব্দ তালিকা ও দালিলিক প্রমাণপত্র, ১০ খণ্ডে ৩ হাজার ৭৬১ পৃষ্ঠার অন্যান্য নথি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আগের দেয়া রায় ও জামায়াতের বিরুদ্ধে পর্যবেক্ষণও দাখিল করবে তদন্ত সংস্থা।
নির্বাচন কমিশনের শর্ত পূরণ না করায় ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছে উচ্চ আদালত। তবে একাত্তরে ভূমিকার জন্য দলটিকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্যও জোরালো দাবি রয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল হিসাবে কর্মকাণ্ড চালালেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার জন্য কখনোই ক্ষমা চায়নি জামায়াত, বরং দলটির শীর্ষনেতারা স্বাধীনতার পরও বলেছিলেন, একাত্তরে তাদের ভূমিকা সঠিক ছিল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উস্কানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতা দেয়ার দায়ে জামায়াতের তখনকার আমির গোলাম আযমকে গত ১৫ জুলাই ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।
ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে বিচারক বলেন, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়।
ট্রাইব্যুনালের আগের রায়গুলোতেও জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দলটির সরাসরি সংশ্লিষ্টতার বিষয়গুলো উঠে আসে।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন থেকে ‘যুদ্ধাপরাধী’ দল হিসেবে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি উঠে।
জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ের পর গড়ে ওঠা এই আন্দোলনের পর আইন সংশোধন করে দলের বিচারের বিধানও যোগ করা হয়। আগের আইনে শুধু যুদ্ধাপরাধী ব্যক্তির বিচারের সুযোগ ছিল।
গোলাম আযমের আগে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আব্দুল কাদের মোল্লা ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানের সাজার রায়েও একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি উঠে আসে।
গোলাম আযমের মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, সাধারণ জ্ঞান ও দালিলিক প্রমাণাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, জামায়াত ও এর অধীনস্থ সংগঠনের প্রায় সবাই সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন।
“গোলাম আযমের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী একটি ক্রিমিনাল দল হিসাবে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজ করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকালে।”
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় গোলাম আযমের ‘গুরু’ আবুল আলা মওদুদী তার বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় সেই ধরনের ভূমিকাই ছিল গোলাম আযমের।
জামায়াত দুই সময়েই সাধারণ মানুষের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল মন্তব্য করে ট্রাইব্যুনাল দলটির দূরদৃষ্টির অভাবের পেছনে উগ্র মৌলবাদী চেতনাকেই চিহ্নিত করেছে।
“স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও স্বাধীনতাবিরোধী কিছু মানুষ জামায়াতের হাল ধরে আছেন। যার ফলে জামায়াতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নতুন প্রজন্ম স্বাধীনতাবিরোধী চেতনা ও সাম্প্রদায়িক অনুভূতির মানসিকতায় বেড়ে উঠছে, যা দেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগের বিষয়।”
ট্রাইব্যুনাল বলেছে, একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীরা শহীদদের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কিংবা অনুশোচনা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছেন বলে কোনো প্রমাণ জাতির সামনে নেই।
রায়ে বলা হয়, একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়তে সরকারের নির্বাহী বিভাগ, সরকারি বেসরকারি সংগঠনসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক দলের কর্ণধার হিসাবে এ ধরনের স্বাধীনতাবিরোধীরা থাকা উচিত নয়।
এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে স্বাধীনতাবিরোধীরা যাতে না আসতে পারে, সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে বলে রায়ে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩:২৩:০২ ৩৫৪ বার পঠিত