রূপান্তর-রোকসানা লেইস

Home Page » সাহিত্য » রূপান্তর-রোকসানা লেইস
মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০১৪



hijra.jpgমেয়ে কে নিয়ে বেশ ভাবনা হচ্ছে তুরসার বেশ কিছুদিন থেকে। ছোট বেলা থেকে স্বাধীনতা পাওয়া মেয়ে কে হঠাৎ করে কিছু বলতেও বাঁধছে। স্কুলের পড়ালেখার বাইরে গান নাচের অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া ছিল ওর নিত্যদিনের কাজ। পড়ালেখাটা বেশ ভালো ভাবেই চালিয়ে গেছে সাথে, কখনও কোন সমস্যা হয়নি। পাশাপাশি গানে নাচে পুরস্কার অর্জন ছিল বাড়তি পাওনা। হঠাৎ করে ক্লাস এইটে উঠার পর নিজেই গানটা ছেড়ে দিল। গলাটা বড় মিষ্টি ছিল কিন্তু ছাড়ল যে কী পণ করে কে জানে আর কখনো ওকে দিয়ে গান করানো গেল না। অথচ সব ধরনের গানেই কণ্ঠটা ছিল খাপ খাওয়ার মতন। তুরসা ভেবে আজকালকার বাচ্চাদের মন মেজাজের কোন কুল খুঁজে পায় না। নিজের শৈশব কৈশোরের কথা মনে পড়ে। মায়ের ইচ্ছায় গান শিখে। বাবা নামাজ কালামে পোক্ত করার জন্য শক্ত অনুশাসনে রাখেন। দুইজনের দুই মতবাদের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হয়েছে সারা সময়। নিজের কোন ইচ্ছা প্রকাশের সুযোগ করে উঠতে পারেনি কখনও। তবে কখনও বাবা মা এর অবাধ্য হয়ে কিছু করবে বা বলবে এতটা সাহস ছিল না। অথচ নিজের মেয়েকে। স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে সব রকমের সুযোগ ওর চাওয়া, ইচ্ছা পূরণের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। অথচ কোথায় যেন ওরা দূরের মানুষ। এত আধুনিক চিন্তা ভাবনা করেও সন্তানের চিন্তা ভাবনার অনেক পিছনে যেন পড়ে আছে তারা। গান ছেড়ে দিলেও নাচটা শিখা অব্যাহত রাখে।শিবলী মোহাম্মদের কাছে একক ভাবে মৌটুসির নাচ শিখার ব্যবস্থা করতে কত ঝামেলা পোহাতে হয়েছে প্রথমে। পরে অবশ্য ওর নাচের আগ্রহ চট করে মূদ্রাগুলো ধরে ফেলার মেধা শিবলীকেও ছাত্রীর প্রতি আগ্রহী করেছে। পাঁচ বছরের শিক্ষা শেষ করার পরে,স্বামী স্ত্রী গুরু শিষ্যের একক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছিল অনেক খরচ করে। ওর নাচ দেখে অনেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সিনেমা, ভিডিওর ওফার দিয়ে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল।পত্রিকার লোকজন লেগেছিল পিছু কিন্তু ওরাও চায়নি এই কিশোর বয়সে ব্যস্ততায় জড়াতে মেয়েকে। মেয়েরও কোন আগ্রহ ছিলনা প্রচার পাওয়ার, দেখে বেশ স্বস্তি অনুভব করেছিল। কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই মেয়ে যেন সম্পূর্ণ অচেনা হয়ে উঠছে দিনে দিনে। কদিন ধরে দেখছে। একটি ছেলেসহ বাসায় আসছে দুপুরের পরে প্রায় দিন। দুপুর পেরিয়ে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত মৌটুসির নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে ওরা কথা বলে, হাসাহাসি করে বেশ জোরেই। মিউজিকের শব্দও আসে। এই ছেলেটিকে তুরসা আগে কখনও দেখেনি। অথচ পরিচয় করিয়েও দিচ্ছে না মেয়ে। দু একদিন ইচ্ছে করেই সামনে পরেছে তুরসা ওদের। অথচ ওরা এমনই গল্পে মগ্ন হয়ে থেকেছে মাকে যেন চোখেই দেখেনি। ওদের কথা বার্তা আঁচ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে তুরসা। কান পেতে থেকেছে। ওরা বেশ জোরেই কথা বলেছে। কিন্তু শব্দগুলো ঠিকঠাক মতন ধরতে পারেনি তুরসা। ব্যাপারটা বেশ মনঃকষ্ট দিচ্ছে সাথে উদ্বিগ্নও করছে ওকে। রাফির সাথে কথা বলতে গেলে সেও হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। বাদ দাও তো এত চিন্তার কিছু নাই। যেন মেয়ে আগের মতনই ছোট বাচ্চা আছে। নিজের মনের চিন্তা আর আস্থিরতায় বিচ্ছিরি একটা সময় কাটছে তুরসার। নয়মাস পেটে ধরা মেয়ে যার মুখে ভাত তুলে খাওয়ালো এই সেদিন পর্যন্ত হঠাৎ করে তার ব্যবহার অস্বাভাবিক লাগছে মা হয়ে তুরসার কাছে। তবে সবচে বেশী যন্ত্রনার বিষয় হয়েছে যে ভাবনাগুলো ওর জীবন যাপন যন্ত্রনাময় করে তুলেছে সে কথাগুলো বলতে পারছে না। নিজের মনেই বাঁধা পাচ্ছে বারবার। সন্দেহের কথাগুলো শুনে মেয়ে ওর সমস্ত আধুনিকতার দিকে চোখে আঙ্গুল তুলবে। এই ভাবনায় কথাগুলো মুখে এনেও বারবার চেপে যাচ্ছে। আর এটাই হয়েছে মহা যন্ত্রনার কারণ। এত যে আয়োজন করে নাচ শিখল, গত এক বছর ধরে সেই নাচের প্যাকটিসও করে না। অথচ কতগুলো বছর ঠিক একঘণ্টা নাচের অনুশীলন করেছে মেয়ে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা অসুখ পরীক্ষার তোয়াক্কা না করে। কিছুদিন আগে গুরু শিবলী মোহাম্মদের একক নাচের অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ ছাড়াও শিবলী নিজে ফোন করে বলেছিল। অথচ মৌটুসি সে অনুষ্ঠানে গেলো না। রাফিকে নিয়ে তুরসা গিয়েছিল। শিবলীর চোখ ফাঁকি দিয়ে চলে আসছিল অনুষ্ঠান শেষে কিন্তু শিবলী ওদের দেখে এগিয়ে আসল। চারপাশে তাকিয়ে মৌটুসির কথা জিজ্ঞেস করল। তুরসা কিযে এক বিড়ম্বনায় পড়েছিল। তানা নানা করে পরীক্ষা, শরীর খারাপ ইত্যাদি বাহনা করে কাটাল। রাতে খাবার টেবিলে সে কথাটা মৌটুসিকে বলায় ও রেগে উঠল। এভাবে মিথ্যা বলার কী প্রয়োজন ছিল মা? সোজাসাপটা বলে দিবে, আমার যেতে ইচ্ছে হয়নি তাই যাইনি। তুরসা তাজ্জব বনে যায় মেয়ের কথায়।

অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে; ওই টুকুন মেয়েকে। রাফিও হে হে করে মেয়ে কে সায় দেয়। রাগে গা জ্বলে যায় তুরসার। তুমি তা হলে বলোনি কেন তখন। খানিকটা রাগ রাফির উপর ছেড়ে স্বস্তি পেতে চায় তুরসা। তবু অস্বস্থি কাটেনা। গুরু ডাকলে ইচ্ছে হয়নি বলে যাবো না, এমনটা ভাবতে পারে না তুরসা। এদের চিন্তা ভাবনাগুলো কতটা পার্থক্য হয়ে যাচ্ছে আমাদের থেকে, হিসাবটা বড় কঠিন লাগে তুরসার। মাস চার পার হয়ে গেছে মৌটুসির এই নতুন ছেলেটার সাথে চলার। ওরা আছে ওদের নিজের আনন্দে। আর মনের জটিল ভাবনায় তুরসার জীবন বিষিয়ে উঠছে। তোরা যদি প্রেম করছিস তবে সে কথাটা আমাকে খুলে বল। আর ঘরে খিল দিয়ে থাকার সময় আসবে আরো পরে। এভাবে এখনই সব খুইয়ে বসার সময় নয়। আর যদি নিজেরা কোন সম্পর্কে জড়িয়েই পরেছে তবে সামাজিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। যা ভাবে ভাবুক মেয়ে। নিজেকে যন্ত্রনা দেয়ার চেয়ে মেয়ের সাথে খোলামেলা কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয় তুরসা। ছুটির দিন বেশ অয়েসী ভঙ্গীতে ঘুম থেকে উঠল মৌটুসি। দেরি করে ঘুম থেকে উঠার এই অভ্যাসটাও নতুন। আগে তো সকালে উঠে অনুশীলন করত গানের, নাচের। সে সব বিষয়গুলো লাটে উঠেছে। সবাই সব কিছু বদলে ফেলছে। শুধু তুরসা নিজেকে বদলাতে পারছে না। ছুটির দিনগুলো পরিবারের সবার সাথে নাস্তা করার রেওয়াজ নিয়ে এখনও সকালে টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে বসে থাকে। রাফিও আজকাল নাস্তা করতে চায় না। বয়েস হয়েছে মেদ নাকি বাড়ছে। জগিং করে এসে হালকা ফল দুধ খেয়ে নেয় তুরসার টেবিল সাজানোর আগেই। তিনজন মানুষের তিন রকম জীবন যাপন।

তুরসা আজ বসে আছে সকালের নাস্তা নিয়ে টেবিলে। আজ কথাটা বলবে মৌটুসিকে। নিজের ভাবনা গুলো ঝেড়ে ফেলতেই হবে ওকে। ঘড়িতে দশটার ঘন্টা বাজছে টুংটাং করে। আর কতক্ষণ বসে থাকবে ভাবছে তুরসা। মৌটুসি বেরিয়ে এলো ওর ঘর থেকে। চেঞ্জ করেনি। তার মানে ঘরে আছে বেড়িয়ে যাচ্ছে না, ভাবে তুরসা। হাই মা, মরনিং মরনিং তো যেতে বসেছে তবু সব রাগ, অভিমান চেপে রেখে শান্ত ভাবেই উত্তর করে তুরসা। মরনিং। পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মৌটুসি। একটু অবাক লাগে তুরসার। কতদিন মেয়ে এমন করে কাছে আসে না। অথচ আগে ক্ষণে ক্ষণে আদর করত জড়িয়ে ধরত। রাতে ওর মাথায় বীলি করে ঘুমপাড়াতে হতো। চট করে চোখটা ভিজে উঠে। আজ সারাদিন তোমার সাথে কাটাব মা।কলকল করে কথা বলতে বলতে ওর সামনের চেয়ারটা টেনে বসে মৌটুসি। ভেজা চোখের উন্মাদনা সরিয়ে অবাক হবার পালা এবার। দাও মা, খেতে দাও, বড় খিদা পেয়েছে। প্লেটে খাবার উঠিয়ে দেয় তুরসা। প্লেট টেনে খেতে খেতে মৌটুসি বলে, মা তোমাকে একটা কথা বলি। তুরসার উত্তরের অপেক্ষা না করে বলতে থাকে মৌটুসি, গত কয়েক মাস ধরে আমি আর সজল মিলে কিছু গবেষনা করলাম মা।

সজল কে? সজল হলো যার সাথে গত কিছুদিন আমি বাসায় সময় কাটাচ্ছিলাম। ওহ তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই নাই। যাহ্ ভুলে গ্যাছি জ্বীব কাটে মৌটুসি। কিছু মনে করো না। কাজের কথা শোন। তুরসা ভাবে কদিন! কয়েক মাস হয়ে গেল। মেয়ে কোন ঘোরে আছে কে জানে। যাক নিজেই যখন বলতে শুরু করেছে একদিক থেকে ভালো হলো। প্রশ্ন না করে শোনায় মন দিল তুরসা। ঠিক আছে বলো। আমি আর সজল একদিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসছি, হঠাৎ করে কিছু অদ্ভুত সাজগোজ করা মানুষ আমাদের ঘিরে ধরল। আমাদের ঘিরে নাচ করছে। অসম্ভব বাজে শব্দ উচ্চারণ করে গালাগালি করছে, না মজা করছে ঠিক ধরতে পারলাম না আমি। ওরা নানা রকম খিস্তি, অঙ্গভঙ্গি করে আমাদের কাছে টাকা চাইল। সজল ওদের পঞ্চাস টাকা দিতে গেলো । আমার কীযে হলো আমি নোটটা তাড়াতাড়ি নিয়ে আমার ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললাম। ওরা মারমুখি হয়ে উঠল। আমি বললাম শোন, আমি একজন নাচের শিল্পী কিন্তু তোমাদের মতন নাচ কখনও দেখি নাই। আমি তোমাদের নাচ শিখতে চাই। আমি তোমাদের অনেক বেশী টাকা দেবো। ওরা আমার কথা শুনে হেসেই বাঁচে না। তারপর বলল, দে যা দিবি এখনই দে নাচ টাচ শিখা লাগবে না। ওরা কিছুতেই আমার কথা শুনতে চায় না। ওরা কোন কথা বিশ্বাস করতে চায় না। আমি জানতে চাই ওরা কোথায় থাকে, ওরা সুর করে একধরনের গান গায়। অঙ্গভঙ্গি করে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। আমার জেদ চাপে ওদের সম্পর্কে জানার জন্য। জিজ্ঞাসা করি ওরা কে, কি করে, ওরা এমন কেনো? ওরা আমার প্রশ্নে রেগে উঠে। বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করে কাপড় খুলে ফেলতে চায়। কিযে একটা অবস্থায় সময় গড়িয়ে যায়। সজল আমাকে টেনে নিয়ে আসতে চায়। কিন্তু আমি ওখান থেকে আসব না ওদের সম্পর্কে না শুনে। এক সময় আমার কান্না চলে আসে। জানতে চাই কেন তারা বলবে না তাদের কথা আমাকে। অনেক বাক বিতণ্ডার পর এক সময় ওদের কয়েকজন আমাকে বিশ্বাস করে। ওরা বোঝতে পারে আমি আন্তরিক ভাবে ওদেরকে জানতে চাইছি। বলো মা আমার এই বিশ বছর বয়সে আমি কী কোনদিন কোন হিজড়া দেখেছি? তোমাদের কাছ থেকে, পড়ার বইয়ে, শিক্ষকের কাছে কোথাও কোনদিন এই বিষয়ে শুনেছি? অথচ ওরা আমাকে বিশ্বাসই করতে চায় না যে আমি ওদের বিষয়ে কিছুই জানি না। এই সাজানো পরিপাটি তোমাদের শেখানো জীবনের বাইরে, অনেক কিছুই আমি জানি না। জীবনের বাস্তব এবং কঠিন বিষয়ে। ওদের জীবনটা কী দুঃসহ কষ্টের। এই সমাজে প্রতি পল ওদের নিজের জন্মের কষ্ট বয়ে বেড়াতে হয়। অথচ এজন্য ওরা দায়ী নয় মা। এই কথাটাই ওরা জানে না। প্রকৃতির বিরূপ ব্যবহারে তাদের অঙ্গ প্রতঙ্গগুলো সঠিক ভাবে গঠিত হয়নি। সমাজে তাদের নারী ব পুরুষ নামের কোন পরিচয় নাই। পরিবার তাদের এই পরিচয়ের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য দূরে ঠেলে দেয় ছোট বেলায় ওদের পরিবার থেকে। জনো মা, ওদের কথা শুনে আমার এত কষ্ট হয়েছে। শারীরিক বৈকল্যে গঠিত মানুষগুলো সমাজে কী উপহাসের পাত্র। আমাদের সাথে যখন কথা বলছি, তখন পাশে দাঁড়িয়ে অনেকে ওদের উপহাস করছিল। এমন কী ঢিল ছুঁড়ছিল।পুলিশ পর্যন্ত দূরে দাঁড়িয়ে থাকল সাহায্য করতে এগিয়ে আসল না। আমি ওদের নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যেতে চাইলাম ট্যাক্সি ওদের নিতে চাইল না । হোটেলে ওদের ঢুকতে দিল না। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ওদের জন্য বড় করে না দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও ওদের প্রবেশ অধিকার নাই। কিন্তু ওদের তো খেতে পড়তে হয় মা, নাকি? তুমি কী জানো ওরা কেমন করে বড় হয়?

তুরসার অবাক হবার পাল্লা যেন থমকে গেছে মৌটুসির মুখে। এতটুকু মেয়ে কী সব বলছে। কই তুরসা তো এত বয়সে কখনও এসব বিষয় নিয়ে ভাবেনি। সমাজের কিছু বিষয় আছে তা যেন অলিখিত ভাবে এড়িয়ে যাওয়ার একটা ঘোষনা দেয়া আছে। গ্রামে শহরের মোড়ে পাগল দেখা যায়। এই পাগল কার বাড়ির মানুষ, কেনো পাগল, কখনও এমন প্রশ্ন জাগেনি মনে। ঢিল ছুঁড়ে কথা বলে, ছেলে পেলেরা পাগলকে খেপাবে এটাই যেন স্বাভাবিক। কখনও কোন প্রশ্ন নয়। জানার প্রয়োজন নাই শুধু এড়িয়ে যাওয়া শুধু নিজেকে নিজের পরিবারের ভালো মন্দের মাঝে জড়িয়ে থাকা। মেয়ের আলোচনার সম্মুখীন হয়ে লজ্জাই পেলো যেন তুরসা। সহজ ভাবেই বলে, আমি জানি না।

ওদের একটা সমাজ আছে ওখানেই ওরা বড় হয়। কারো হিজড়া বাচ্চা হয়েছে শুনলে ওরা এসে বাচ্চাটাকে নিয়ে যায়। মানুষের বাড়ির জন্মদিনে, বিয়েতে, নানান ধরনের উৎসবে ওরা জোর করে গান বাজনা করে, জোর করে পয়সা আদায় করে নিয়ে যায়। কেউ ওদের কোন সুযোগ দেয় না। বড় প্রতিযোগিতা করে বাঁচতে হয় ওদের এই সমাজে। অথচ ওদের জন্মের জন্য ওরা দায়ী নয় মা। বিদেশের সমাজ অনেক এগিয়ে গেছে যদিও আমাদের মতনই ছিল ওদের জীবন যাপনও এক সময়। স্বাভাবিক নারী পুরুষও ইচ্ছে করলে তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী থেকে পুরুষ বা পুরুষ থেকে নারী হয়ে যাচ্ছে। প্রথম যে ছেলেটি, ছেলে থেকে নারী হয়েছিল ১৯৫৮ সনে। আমেরিকায় সে অপারেশন করতে পারেনি। তাকে যেতে হয়েছিল নেদারল্যান্ড। ছেলে থেকে মেয়ে হয়ে যখন ফিরে এলো নিজ দেশে, আমেরিকার মানুষরাও তাকে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করছিল। নেদারল্যাণ্ডে খবরটা প্রচার হওয়ার পর যে খালার বাড়িতে থাকত, সেখানে লোকের ভীড় লেগে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে পালিয়ে অন্য শহরে গিয়ে লুকিয়ে ছিল অনেক দিন। এত কিছু তুই জানলি কী ভাবে? এই এতোদিন আমি আর সজল মিলে ইন্টারনেটে হিজড়া সম্পর্কে জানতে গিয়ে অনেক বিষয়ে জানলাম। অনেক পড়ালেখা করলাম। অনেক মুভি ছবি দেখলাম। সজলও ওর জীবনের একটা গতি পেয়ে গেলো।

ওর আবার কী হয়েছে? ও কী হিজড়া নাকি? তুরসা অবাক হয়ে জানতে চায়।

না মা, ও হিজড়া নয়। তবে ও সমকামী। চমকে উঠে তুরসা প্রশ্ন করে, কেন ওকে এমন হতে হবে কেন? ও তো ইচ্ছা করে কিছু করছে না মা। ওর বিষয়টাও একধরনের ব্যতিক্রম। সাধারন মানুষের থেকে। ওরা সমলিঙ্গের মানুষের প্রতিই আগ্রহ অনুভব করে। ও তো চেষ্টা করে এমন চিন্তা বদল করতে পারে। পারে না। এটা ইচ্ছার বিষয় না। তুমি যে এত ভক্ত গায়ক ‘এলটন্ জনের’ সেও সমকামী জান কী? পৃথিবীর কত কিছু ঘটছে কত কিছুই তুরসা জানে না। মেয়ের কাছে বড় ম্রিয়মাণ মনে হয় নিজেকে। তো সজলের কী গতি খুঁজে পেলো? প্রশ্নটা করেই বসে তুরসা। ও ঠিক করেছে চলে যাবে বিদেশের কোন দেশে, যেখানে সমকামীদের বিয়ে হয়। একসাথে থাকার সুযোগ আছে। এখানে থাকলে তো ওর জীবনটাও সব কিছু থেকে বঞ্চিত থাকবে। মারাও যেতে পারে উগ্রপন্থীর হাতে সমকামী বলে।

তুরসা খানিক বিব্রত হযে বলেই ফেলে, আমার খুব অস্থির লাগত তোদের ঘরে দরজা বন্দ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটানো দেখে। হো হো করে হেসে উঠে মৌটুসি বলে, তোমার অবস্থাটা এখন আমি বুঝতে পারছি মা। তবে জান কী সজলের সাথে থাকা অনেক সেফ। ও ধরো আমার একটা মেয়ে বান্ধবীর মতন। আমার প্রতি ওর কখনও আগ্রহ জাগবে না। মৌটুসির মোবাইলটা বেজে উঠে এ সময়ে। ফোনে কথা বলেও। বেশ জোরেই, কিন্তু কী কথা বলল, তুরসা বিন্দু বিষর্গ বুঝতে পারে না। মিনিট পাঁচেক কথা বলা শেষ করে বলে, আরেক কাপ চা দাও মা। তুরসা চা নিয়ে আসে নিজের জন্যও এক কাপ নিয়ে বসে। জানতে চায়, কার ফোন? সজল ফোন করেছিল, কাল আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।

তোর কথা কিছুই তো বুঝতে পারলামনা, কী ভাষায় কথা বলিস? ওহ্ মা আমরা ফ্রেঞ্চ শিখছি, তাই দুজন যখন কথা বলি, ভাষাটা প্যাকটিস করি।

মাথাটা ঝিমঝিম করছে তুরসার। নিজের গণ্ডিবদ্ধ ভাবনার বাইরে এত কথা হঠাৎ করে কেমন এলোমেলো করে দিচ্ছে চিন্তা ভাবনা। চায়ে চুমুক দিয়ে চুলগুলো পিছনে ঝাঁকিয়ে নিয়ে মৌটুসি আবার বলে, মা তোমাকে আরেকটা কথা বলি। আবার কী ভয়াবহ কথা বলবে মেয়ে কে জানে। তবু তুরসা স্বাভাবিক ভাবেই বলে, বলে ফেলো। আমরা একটা প্রতিষ্ঠান

করতে যাচ্ছি যেখানে হিজড়াদের সহযোগিতা করা হবে। তারা মানুষ শুধু তাদের স্বাভাবিক গড়ন সঠিক ভাবে গড়ে উঠেনি। যেমন কিছু মানুষ আবার স্বাভাবিক শরীর নিয়ে জন্ম নিয়ে তাদের মস্তিষ্ক স্বাভাবিক ভাবে গড়ে উঠে না। মেণ্টাল ডিজেবোল। প্রকৃতির কি ভয়াবহ বিরূপ প্রতিক্রিয়া মানুষের উপর। এবার তুরসা বলে, তারচেয়েও ভয়াবহ মেন্টাল ডিজেবোল, যারা দেখতে স্বাভাবিক, চলাফেরা স্বাভাবিক কিন্তু মনের মাঝে মহা কুটিল। যাদের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবন হয়ে উঠে ক্ষতির সম্মুখিন। তা খুব ঠিক বলেছো মা। মা এইজন্য আমরা চাইছি আমরা যে সংগঠনটি চালাবো সেখানে তুমি থাকো আমাদের সাথে। ছোট্ট মেয়েটা সত্যি বড় হয়ে গেছে উপলব্ধি করল তুরসা। উঠে ওর কাছে গিয়ে আদর করে বলল থাকবরে মা তোদের সাথে। তোদের সাথে থেকে অনেক কিছু শিখতে হবে আমাকে।

বাংলাদেশ সময়: ১:১৯:১০   ৫৬৮ বার পঠিত  




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

সাহিত্য’র আরও খবর


সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন: স্বপন চক্রবর্তী
ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা “আমি তো গাঁয়ের মেয়ে ”
৫০ বছরের গৌরব নিয়ে জাবির বাংলা বিভাগ বিশাল ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব আয়োজন করেছে
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা- ‘তোমার খোঁজে ‘
অতুলপ্রসাদ সেন: ৩য় (শেষ ) পর্ব-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন;পর্ব ২-স্বপন চক্রবর্তী
অতুলপ্রসাদ সেন-স্বপন চক্রবর্তী
অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগমের কবিতা ” যাবে দাদু ভাই ?”
বাদল দিনে- হাসান মিয়া
ইমাম শিকদারের কবিতা ‘ছোট্ট শিশু’

আর্কাইভ