মো: ফয়সাল আজাদ, বঙ্গনিউজ ডট কম: পরিবেশের প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়লাভ করিয়া মানুুষ ভবিষ্যতের সোনালি দিনগুলির সূচনা করিয়াছিল। সংগ্রাম ও সাধনার এই ধারাই হইতেছে মানব ইতিহাস। আগুন জ্বালাইতে শিখিয়া মানুষ একদিন সভ্যতার উদ্বোধন করিয়াছিল। তবু হাজার প্রতিকূলতার মোকাবিলায় মানুষকে সতত সজাগ থাকিতে হইতেছে। “মানুষ গড়িতেছে আর ঈশ্বর ভাঙ্গিতেছে”- এই নীতি প্রচলনের সাথে মানুষের পরিচয় নিত্যকালের। বিংশ শতাব্দীর বহুমুখী বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি অনেক অসাধ্য সাধন করিয়াছে। বিজ্ঞান মানুষকে গুহা হইতে বাহির করিয়অ চাঁদে পৌছাইয়াছে। সর্বোপরি ইহা মানুষের জীবনকে করিয়াছে আরামদায়ক, স্বাচ্ছন্দ্যময় ও অনেকাংশে নিরাপদ। কিন্তু তবু মানুষ পারে নাই মৃত্যুকে জয় করিতে পারে নাই আকস্মিক দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকে প্রতিহত করিতে। তাইত এখন দেখা যায় যেকোনো মূহূর্তে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি পরিবারের সবাইকে আর্থিক দুর্ভাবনায় ফেলিয়া মৃত্যু বরণ করে; যে কোনো সময় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বহু মূল্যবান দালান-কোঠা ভস্মীভূত হয়, গভীর সমুদ্রে জাহাজ ও পণ্য বিনষ্ট হয়; মোটর, রেল ও কলকারখানায় অহরহ আকস্মিক দুর্ঘটনায় অনেকে অঙ্গ হারায় এবং সাইক্লোন, গর্কির মতো প্রকৃতিক দুর্যোগে মানুষ সর্বহারা হয়। এইরূপে মানবজাতির সংগ্রামের ইতিহাস শুধুমাত্র জয়ের বার্তাই বহন করিয়া আনে নাই। সহস্র প্রতিবন্ধকতা এখনও আমাদের সামনে পর্বত প্রমাণ বাধা হইয়া রহিয়াছে।
মানব জীবনের এই অনিশ্চয়তা ও অসহায়তা যুগে যুগে কবি ও দার্শনিকদের উপজীব্য বিষয় হইয়া উঠিয়াছে। জন্মলগ্ন হইতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত মানুষকে এক অনিশ্চয়তার মধ্যে বাস ও কাজ করিতে হয়। এমনকি খুব সতর্ক মানুষও জীবনে এই অনিশ্চয়তাকে এড়াইতে পারে না। সৃষ্টির আদিকাল হইতে অদ্যাবধি মানুষের ইতিহাস পর্যালোচনা করিলে দেখা যায় যে, সেকালে যেমন মানুষের জীবন কিংবা সম্পত্তির কোনো নিরাপত্তা ছিল না, আজও তেমনি জীবন ও সম্পত্তির খুব বেশি নিরাপত্তা নাই। যে কোনো সময় যে কোনো দুর্ঘটনায় মানুষ সবকিছু, এমনকি তাহার মূল্যবান জীবন পর্যন্ত হারাইতে পারে। অবশ্য পরিমাণ অনুযায়ী দুর্ঘটনাজনিত এই ক্ষতির প্রকারভেদ আছে। যেমন একজন যদি সামান্য একটি পেন্সিল হারায়, তবে উহাতে তেমনি কিছু যায় আসে না, কিন্তু কোনো ব্যক্তির একমাত্র বাসভবন বা গুদামজাত পণ্য যদি আগুনে ভস্মীভূত হয় কিংবা কোনো ব্যবসায়ীর পণ্যবাহী জাহাজ যদি সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়, তাহা হইলে এই অত্যধিক আর্থিক লোকসানে উক্ত ব্যক্তির নিঃসম্বল হইয়া পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ক্ষতির এই বাস্তবতা অনতিক্রমনীয় এবং প্রতিবছর ক্ষতির এই ব্যাপকতা মর্মম্পর্শী। তাহা ছাড়া ইহা কখন, কোথায়, কাহার উপর সংঘটিত হয় তাহা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। বিগত দুই এক শতাব্দী হইতে বিভিন্ন দেশে শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে জটিলতর সামাজিক পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন ও সম্পত্তি আরও নিরাপত্তাহীন হইয়া পড়িতেছে। অকাল-মৃত্যু, ভূমিকম্প, বন্যা, চুরি-ডাকাতি, হ্যাইজাক-রাহাজানি, রোগাক্রমণ, দুর্ঘটনা, অগ্নিকাণ্ড, সাইক্লোন গর্কি, বেকারত্ব, অসাধুতা, গাফিলতি ইত্যাদির ফলে কোনো রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বিশেষের জীবন বা সম্পত্তির যে ক্ষতি ঘটে, তাহা যদি টাকার হিসাবে প্রকাশ করা হয় তাহা হইলে উহা একটি বিরাট অঙ্ক হইয়া দাঁড়াইবে। তাই এই সমস্ত ঝুঁকির বাস্তবতা স্বীকার করিয়া ইহাকে এড়াইতে বা কমাইতে সর্বাত্মক ও সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা গ্রহন করা সাঞ্ছনীয় এবং উক্ত ঝুঁকি হইতে উদ্ভুত মানুষের সর্বনাশ ও ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো বর্তমান প্রগতিশীল সমাজের দায়িত্ব বলিয়া গণ্য করা হইয়াছে।
দার্শনিকদের মতে বিশ্বের সমস্ত কাজই নিয়মাধীন। তাঁহাদের চিন্তাধারায় দৈবের কোনো স্থান নাই। যে সমস্ত ঘটনাকে সম্পূর্ণ আকস্মিক বলিয়া মনে হয়, উহা সংঘটনের আভাস পূর্বেই পাওয়া যায়। মানুষের সামগ্রিক অসামর্থ্যরে জন্যই দুর্ঘটনা ঘটে। মানুষ এই সম্পর্কীয় সমস্ত পূর্বশর্ত বা সমস্ত নিয়মকানুন জানে না বলিয়া কোনো বিশেষ ঘটনাকে তাহাদের নিকট দৈব বলিয়া মনে হয়। এই অর্থে মানব জ্ঞানের অপরিপক্বতা হইতে উদ্ভূত পূর্বধারণাতীত কিছুর নিছক আবির্ভাবই দৈব। ইহা বহিঃপ্রকৃতির স্বাভাবিক গতির কোনো অংশ হিসাবে চিহ্নিত নয়। যাহ হউক, প্রকৃতি বিষয়কে জ্ঞানের অসম্পূর্ণতার জন্য মানুষ পদে পদে অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয় এবং অনিশ্চয়তা থাকিলেই ঝুঁকির প্রশ্ন আসে। অন্য কথাই অনিশ্চয়তাই ঝুঁকি এবং এই অনিশ্চয়তা মানব জীবনের আনুষঙ্গিক বিষয়। প্রকৃত বিষয়ে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি এবং সেই শক্তিকে আয়ত্তাধীন করার সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি নিরোধ করার উপায়ও মানুষ বাহির করিয়াছে। কিন্তু তবু যতদিন মানুষের জীবন অনিশ্চয়তা থাকিবে ততদিন মানুষের অনিরাপত্তাবোধও দূর হইবে না। এই নিরাপত্তা বা ঝুঁকি নিরোধ মানুষের মৌল কামনা এবং ইহার সন্ধানও তাহাদের বহু দিনের। নানা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষার পর মানুষ উপরোক্ত ঝুঁকি রোধ করার বিবিধ পন্থা বাহির করিয়াছে।
ঝুঁকি পরিহার পদ্ধতি
(ক) ঝুঁকি অনুুধাবন
ঝুঁকি অনুধাবন অনিশ্চয়তা রোধের ন্যূনতম পন্থা। অজ্ঞ বা ইচ্ছাকৃতভাবেও তাহা করা যায়। আলোবিহীনভাবে বা একাধিক আরোহী লইয়া সাইকেল চালনা আইনত দণ্ডণীয়, কিন্তু বহু সাইকেলধারী ইচ্ছাকৃতভাবে অনেক শহরে এই ঝুঁকি গ্রহন করিয়া থাকে। কোনো কোনো যাত্রী স্কুল-কলেজগামী ছাত্র বিনা টিকেটে রেলগাড়িতে ভ্রমণ করিয়া থাকে। অবৈধ সঞ্চয় বা নিছক খেয়ালের জন্য তাহরা এই অভ্যাস অব্যাহত রাখে এবং দৈবাৎ ধরা পড়িয়া জরিমানা প্রদান করে। তবে অধিকাংশ ব্যক্তিই ব্যাক্তিগত এবং সামাজিক কারণে এই পন্থা অবলম্বন করিতে ইচ্ছুক নয়। ঝুঁকির মাত্রা অধিক বলিয়া ইহা বিশেষভাবে ব্যয়বহুলও বটে।
(খ) সঙ্কটকালীন তহবিল সৃষ্টি
এই তহবিলে সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ করার জন্য কিছু অর্থ জমা করিয়া সংরক্ষিত রাখা হয়। এই পদ্ধতি উপরোক্ত পদ্ধতি হইতে ভিন্ন। ক্ষতি সংঘটিত হইলে ক্ষতিগ্রস্থ বা নষ্ট সম্পত্তিগুলিকে পুনঃস্থাপনের বিশেষ উদ্দেশ্য লইয়া নিয়মিতভাবে টাকা জমা রাখিয়া এই তহবিল গঠন করা হয়। অনাদায়ী দেনা হইতে উদ্ভূত ক্ষতি মিটাইবার জন্য অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যে অনাদায়ী দেনা তহবিল (নধফ ফবনঃ ৎবংবৎাব) গঠন করে ইহা অনেকটা সেইরূপ। কিন্তু এই ব্যবস্থার কিছু দোষক্রুটি আছে। সাধারণত তহবিলের আকার ও আয়তন প্রভৃতি অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক নীতি অপেক্ষা অনেকাংশে ব্যক্তিগত মতামত ও নগদ অর্থে নির্ধারিত হইয়া থক্ েঅধিকন্তু তহবিলের প্রথমিক অবস্থার ক্ষতি সংঘটিত হইলে সেই তহবিল হইতে ক্ষতি মিটানো সম্ভব হয় না। তবু এই পদ্ধতি প্রথমোক্ত পদ্ধতি হইতে অনেকটা উন্নত এবং অন্য পন্থা লাভজনক না হইলে ক্ষতি মিটানোর ইহাই শ্রেষ্ঠ পন্থা।
(গ) ক্ষতির হ্রাস ও নিবারণ
ঘরবাড়ি ও দালান কোঠা নির্মাণে জমাট বস্তু ও ইস্পাত দ্রব্যাদি ব্যবহার করিলে এইগুলি ইঁদুর, অগ্নি ইত্যাদি দ্বারা ক্ষতি হইলে রক্ষা পায়। একটি সুসংগঠিত পুলিশ বাহিনী তৎপর থাকিলে চুরি-ডাকাতি কমিয়া যায়। দক্ষ দমকল বাহিনী এবং দালান তৈয়ারির সুষ্ঠু নীতিপালনে অগ্নি-উদ্ভূত ক্ষতি হ্রাস পায়। কারখানার যথাযথ নিয়মকানুন পালন করিলে দুর্ঘটনা কম হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের আগ্রগতি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিভিন্ন দেশে বহু রোগ নিরোধ করিয়াছে। আগ্নি নির্বাপক যন্ত্র বা স্বয়ংক্রিয় অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা থাকিলে তাহা অগ্নি সংযোগ পুরাপুরি বন্ধ করিতে না পারিলেও ইহার ভয়াবহতা কমায়। তবে কোনো নির্দিষ্ট পন্থা দ্বারা সমস্ত ক্ষতি দূরীভূত করা সব সময় সম্ভব হয় না। অধিকন্তু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ হইতে নিরোধিত ক্ষতি অপেক্ষা নিরোধ ব্যবস্থার ব্যয় যদি বেশি হয়, তাহা হইলে উহা পরিত্যজ্য।
(ঘ) ঝুঁকির স্থানান্তর
আত্মরক্ষার্থক চুক্তি উপচুক্তি, জামিনদারী প্রতিজ্ঞাপত্র ও সীমাবদ্ধ দায়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গঠন ইত্যাদি পদ্ধতির দ্বারা ঝুঁকি অন্যজনের কাছে স্থানান্তরিত করা যায়। এই পদ্ধতিতে তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে চুক্তি করিয়া ঝুঁকি হ্রাস করা হয়। তবে ব্যক্তি বিশেষের আয়ভুক্ত প্রভূত একক মুনাফার সম্ভাবনা তখন সেই অনুপাতে কমিয়া যায়।
(ঙ) বীমার মাধ্যমে ক্ষতি বিতরণ
বীমা হইল দুই পক্ষের মধ্যে এমন একটি চুক্তি, যাহার মাধ্যমে একপক্ষ অপরপক্ষকে প্রিমিয়াম হিসাবে টাকা প্রদান করে এবং ইহার বিনিময়ে অপরপক্ষ প্রথম পক্ষের কোনো দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ প্রদান করিতে স্বীকৃত হয়। এখানে বিশেষ ঝুঁকিগ্রস্ত ব্যক্তি অনুরূপ ঝুঁকিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহিত মিলিত হইয়া ঝুঁকির মাত্রা অনেকটা হ্রাস করিয়া ফেলে। একই শ্রেণীল ঝুঁকিগুলি যখন একত্রিত করা হয়, তখন ক্ষতির সম্ভাবনা অধিকতর নিশ্চিত হইলে ব্যক্তি বিশেষের ঝুঁকি কমিয়া আসে। এই ক্ষেত্রে ক্ষতির কত অংশ প্রিমিয়াম আকারে পরিশোধ করিতে হইবে দলের সদস্যগণ তাহা জানিতে পারে। এইরূপে কোনো ব্যক্তি বীমা কোম্পানিকে সামান্য অর্থ প্রিমিয়াম আকারে প্রদান করিয়া তাহার বড় রকমের অনিশ্চয়তা হস্তান্তর করিতে সক্ষম হয়। নিম্নোক্ত উদাহরণ হইতে ইহা আরও পরিষ্কার করিয়া বুঝা যাইবে। মনে করা যাক, সমুদ্রগামী কোনো একটি জাহাজে ৫০ হাজার টাকার পণ্য বোঝাই রহিয়াছে এবং পণ্য মালিক উক্ত টাকার পণ্যের জন্য নৌবীমা কোম্পানির নিকট হইতে প্রিমিয়াম প্রদান করিয়া উক্ত টাকার নৌবীমা গ্রহণ করিল এবং এমতাবস্থায় সমুদ্র পাড়ি দিবার সময় এই পণ্যবাহী জাহাজ সামুদ্রিক কোনো দুর্ঘটনায় সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হইল এবং উহার ফলে সমস্ত পণ্যাদি বিনষ্ট হইয়া গেল। এই ক্ষেত্রে বীমাগ্রহীতা উক্ত বিনষ্ট পণ্যের মূল্য হিসাবে বীমাকৃত ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করিতে পারিবে এবং বীমা কোম্পানিও উক্ত চুক্তি অনুযায়ী বীমাকৃত ৫০ হাজার টাকা বীমাগ্রহীতাকে দিতে বাধ্য থাকিবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৪৫:৩৯ ৭৪৭ বার পঠিত