সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন , নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ নেই

Home Page » জাতীয় » সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন , নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ নেই
রবিবার ● ৯ ফেব্রুয়ারী ২০২৫


 ফাইল ছবি

বঙ্গনিউজ : বাংলাদেশে আগামীতে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সুপারিশ বা প্রস্তাব দেয়নি নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য না হওয়ায় প্রতিবেদনে বিষয়টি রাজনীতিবিদদের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পূর্বঘোষিত সময় অনুযায়ী গতকাল শনিবার সরকারের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এদিন একই সঙ্গে আরও পাঁচ কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও প্রকাশ করে সরকার।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলমের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন নিজেদের মধ্যে ৬৪টি এবং অংশীজনের সঙ্গে ২২টি বৈঠকের পর ১৮৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আপত্তি সত্ত্বেও সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে ইসির পরিবর্তে একটি আলাদা সীমানা নির্ধারণ কমিশন গঠনে সংবিধান সংশোধনের পরামর্শ দেওয়া হয়। আর আলাদা কমিশন গঠন না করা পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক নির্বাচন কর্মকর্তা, ভূগোলবিদ, মানচিত্রকার, পরিসংখ্যানবিদ, নগর পরিকল্পনাবিদ, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং জনসংখ্যাবিদসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদন তুলে দেন কমিশনের সদস্যরা। সে সময় প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছিল।

গতকাল প্রকাশিত পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের ৮৯ পৃষ্ঠায় ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন’ অনুচ্ছেদে বিদ্যমান এবং সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির সুফল ও কুফল সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে বলা হয়, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা আমাদের জাতীয় অঙ্গীকারও বটে। চরম জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত দখলদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পলায়ন আমাদের জন্য বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর এবং কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে।’

একই অনুচ্ছেদের ‘বিকল্প নির্বাচন পদ্ধতি’ অংশে বলা হয়, বাংলাদেশে বর্তমানে আসনভিত্তিক ‘ফাস্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (এফপিটিপি) বা আসনভিত্তিক পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এটি একটি জনপ্রিয় এবং অপেক্ষাকৃত সহজ পদ্ধতি। তবে এফপিটিপি বা আসনভিত্তিক পদ্ধতির অনেকগুলো গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যার অন্যতম হলো এ পদ্ধতিতে অনেক সময় রাজনৈতিক দল তাদের প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতে আসন পায় না। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের হার কাছাকাছি হলেও তাদের প্রাপ্ত আসনের সংখ্যায় প্রায়ই ব্যাপক তারতম্য ঘটে। ফলে এ ব্যবস্থায় প্রাপ্ত আসনের সংখ্যায় দলের জনসমর্থনের যথার্থ প্রতিফলন ঘটে না। সংসদে রাজনৈতিক দলের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। এটি সুস্পষ্ট যে বিদ্যমান আসনভিত্তিক এফপিটিপি পদ্ধতির কারণে সামান্য ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েও সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা সম্ভব হয়। আর এ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে সরকারগুলো ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে অতীতে একাধিকবার সংবিধান সংশোধন করেছে, যা দেশে ‘টিরানি অব দ্য মেজরিটি’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বৈরাচার সৃষ্টি করেছে।

অন্যদিকে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সংসদের আসন সংখ্যা ভাগ হয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভোটপ্রাপ্তির অনুপাতের হারে। এ ব্যবস্থায় ভোটাররা ভোট প্রদান করেন রাজনৈতিক দলকে, কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীকে নয় এবং রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত আসন সংখ্যা নির্ভর করে দলের প্রাপ্ত ভোটের হারের ওপর। দেশে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু থাকলে পঞ্চম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের হারের প্রায় সমতার কারণে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আসন প্রাপ্তির সংখ্যাও অনুরূপ প্রায় সমান সমান হত। সে দুটি নির্বাচনে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ যথাক্রমে ৯৩ ও ৯০ এবং ১২৩ ও ১২০ আসন পেত। একইভাবে সপ্তম ও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও ভোট প্রাপ্তির অনুপাতের হারে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা নির্ধারিত হত। ফলে এ চারটি নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের কারও পক্ষেই এককভাবে সরকার গঠন করা সম্ভব হতো না। উভয় দলকেই অন্য কোনো দলের বা দলগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার গঠন করতে হতো। তবে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির একটি বড় দুর্বলতা হলো সরকারের সম্ভাব্য অস্থিতিশীলতা। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির আরও অনেক দুর্বলতা রয়েছে, যা অংশীজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময়ে উঠে এসেছে। সেখানে অংশীজনের মধ্যে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির দাবি উঠলেও এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম মতবিরোধ রয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাবের কারণে নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের বিষয়ে কোনোরূপ সুপারিশ করা থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। বিষয়টি সম্পর্কে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দেওয়াই যৌক্তিক বলে মনে করেছেন কমিশনের সদস্যরা।

এদিকে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কোনো সুপারিশ করতে না পারলেও ‘রান-অফ নির্বাচন’ এর কথা তুলে ধরেছে কমিশন। তারা বলেছেন, রান-অফ পদ্ধতি দুই ধরনের হতে পারে। এক ধরনের রান-অফ পদ্ধতি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে বিজয়ী প্রার্থীকে ভোট পড়ার হারের ৫০ শতাংশের বেশি পেতে হয়। যদি কোনো প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পায়, তাহলে পরে ভোট হয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত দুই প্রার্থীর মধ্যে। এভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতে থাকে যতক্ষণ না কোনো এক প্রার্থী ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পায়। এর বিপরীতে আরেকটি ‘সিম্পল’ বা সহজ রান-অফ পদ্ধতি আছে, যেখানে সব প্রার্থী মিলে একটা নির্দিষ্ট শতাংশের ভোট না পেলে আবার নির্বাচন হয়।

এদিকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ধারা ৩৭-এর পর ধারা ৩৭ক যুক্ত করার মাধ্যমে জাতীয় নির্বাচনে কোনো আসনে মোট ভোটের ৪০ শতাংশের কম ভোট পড়লে ওই আসনের নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে কমিশন। তবে উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে বিধানটি প্রযোজ্য না করার কথাও বলেছেন তারা।

আউয়াল কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ: বিগত কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের দেওয়া বিতর্কিত দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আউয়াল কমিশন ২০২৩ সালে যেসব বিতর্কিত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন দিয়েছে, তদন্ত সাপেক্ষে সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১:০৬:৫৮ ● ৮০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ