সাজেদা আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি, বঙ্গনিউজ :
‘আংসা খাসে পাংসা খাসে আরো খাসে ঝল
কারবা বন্ধু পাইরা রোসে হড়া গাছের তল।
ঐরা যায়রে শুরগুলি দুইয় রাঙা ঠট,
কি কথা কয় তয় কইয়া যারে মগ।
বনপড়া যায় পুতুল পাতাল উইরা পরে ছাই,
ছাই খাবো নামিবোতে খোপা দাংরী ভাই।’
নিজস্ব ভাষায় এ রকম সংগীত, ছড়া, নৃত্য, গল্প, নাটক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সমতলের আদিবাসী বানাই জনগোষ্ঠীর জাতীয় সংগঠন “বাংলাদেশ বানাই কল্যাণ সংগঠন” এর দ্বিতীয় ‘জাতীয় সম্মেলন ২০২৪’।
দীর্ঘ আট বছর পর বাংলাদেশে বসবাসরত বানাই জনজাতির প্রায় ৭০ টি পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হলো বানাইদের সর্নবৃহৎ এ আয়োজন।
গত ২৩ ডিসেম্বর সোমবার সকাল ১০টা থেকে দিনব্যাপী সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার বংশীকুণ্ডা উত্তর ইউনিয়নের বহেরাতলী গ্রামে অনুষ্ঠিত
এ সম্মেলনকে ঘিরে ঐতিহ্যবাহী পোষাক ‘পাঠিন বুনন’এ সেজেছিল বানাই নারীরা। সম্মেলনে প্রার্থনা ও আলোচনায় ছিল নিজস্ব ভাষার উপস্থাপন।
সম্মেলন সোমবার সন্ধ্যায় শেষ হলেও সম্মেলনকে কেন্দ্র করে গতকাল মঙ্গলবারও উৎসবমুখর পরিবেশ ছিল বানাইদের গ্রামে। ছিলো ঘরোয়া পরিসরে বিলুপ্ত হতে যাওয়া বানাইদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানান পরিবেশনা।
নিজস্ব ভাষায় উপস্থাপনার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন,বাংলাদেশ বানাই কল্যাণ সংগঠনের জাতীয় কমিটির সভাপতি বিশ্বেশ্বর বানাই।
সংগঠনের জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব রিপন বানাই এর সঞ্চালনায় আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন আদিবাসী ট্রাইব্যাল এসোসিয়েশনের সভাপতি তারিনী আজিম, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি ও ক্রীড়া সম্পাদক উজ্জ্বল আজিম,বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠন মধ্যনগর উপজেলা শাখার সভাপতি কবি ও লেখক হাজং শ্রী দশরথ চন্দ্র অধিকারী, আদিবাসী ট্রাইব্যাল এসোসিয়েশন মধ্যনগর উপজেলার সভাপতি অজিত হাজং,সুনামগঞ্জ সরকারি জুবিলি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক সুদাস হাজং প্রমূখ।
সম্মেলনে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রায় তিন শতাধিক বানাই জনজাতির লোকজন সহ স্থানীয় অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজন অংশগ্রহণ করেন।
সম্মেলনে আলোচনা সভা পর্বে বক্তারা বলেন,
পৃথিবীব্যাপী আদিবাসীদের অধিকার বঞ্চিত হবার ইতিহাস প্রায় একই রকম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। এমনকি পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের অনেক বঞ্চনা একই ধরনের। সাংবিধানিক স্বীকৃতি থেকে শুরু করে ভূমি ও বনের উপর তাদের অধিকার, চাকুরী, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত যুগের পর যুগ। পাহাড়ের আদিবাসীরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কিছুটা যুক্ত হলেও সমতলের আদিবাসীদের জন্য এখনও এমন কিছু করা হয়নি। রাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এই পরিস্কার বৈষম্য জিইয়ে রেখেছে। আমাদের সংবিধান বলছে, রাষ্ট্র তার জনগণের প্রতি কোনো রকম বৈষম্য তৈরি করবে না, করতে পারে না। অথচ দেশের পরতে পরতে রয়েছে এমন বৈষম্য ও অন্যায়। রাষ্ট্রের এমন বৈষম্য সংবিধান পরিপন্থী ও অন্যায্য।
তারা আরও বলেন, গত জুলাই আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ একটি নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরি করেছে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ছাত্র জনতা নিজেদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে অপার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সমতলের আদিবাসী ছাত্র সমাজ, যুব সমাজ, সংগঠন সর্বোপরি আদিবাসী জনতা একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সুযোগ ও সম্ভাবনা বারবার আসে না। সমগ্র বাংলাদেশের জন্য যেমন একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে তেমনি সমতলের আদিবাসীদের জন্যও। এখনই উত্তম সময় নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করা। সমতলের আদিবাসী ছাত্র সমাজ এক্ষেত্রে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে পারে। তাই আসুন সবাই মিলে নিজেদের অধিকার বুঝে নেই। রাষ্ট্রটি আমাদের তাই নিজেদের অধিকার নিজেদের নিশ্চিত করতে হবে। অন্যকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। দোষ দেওয়া সমাধান নয়, সহযোগিতা সমাধানের উপায়।
বক্তারা আদিবাসী, বাঙালি সবাই মিলে আগামীর মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার আহবান জানান।
সম্মেলনে সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন সহ আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের দুইটি দাবী জোরালো ভাবে উত্থাপন করা হয়।
মধ্যাহ্ন বিরতির পর আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজস্ব ভাষায় ছড়া, কবিতা, গল্প, নাটক, গান ও নৃত্যে মেতে উঠেছিল বানাই নর-নারী। উপচে পড়া উচ্ছাসে মুখরিত হয়েছিল সম্মেলনস্থল।
সমাপনী আলোচনায় সংগঠনের জাতীয় কমিটির কোনপ্রকার রদবদল না করে বহাল রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহনের মধ্যদিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষনা করা হয়।
উল্লেখ্য বাংলাদেশে বানাই সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন সর্বমোট ৩২৩ জন। মধ্যনগর উপজেলার মোহনপুর ও বহেরাতলী দুইটি গ্রামে ৬৩টি পরিবারে ২৭৬ জন বানাই বসবাস করেন। এছাড়া নেত্রকোনার বালুচড়া গ্রামে ৫টি পরিবার ও ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার গানই গ্রামে আরও ২টি পরিবারের বসবাস রয়েছে।
সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ছবি :