বঙ্গনিউজ ডেস্কঃ সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি বেশ পুরোনো। অবশেষে চাকরিপ্রত্যাশীর জন্য আসছে সুখবর। বাড়ছে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা। পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে অবসরে যাওয়ার সময়ও। এ নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ চলছে।
চাকরির বয়সসীমা বাড়াতে এ বিষয়ক বিধি-বিধান কোথায়, কী সংশোধনের প্রয়োজন হবে– তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স যথাক্রমে ৩৫ ও ৬৫ নির্ধারণ করার দাবি উঠলেও মানুষের গড় আয়ু বিবেচনায় নিয়ে বয়সসীমা চূড়ান্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চাকরিতে আবেদনের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৩২ এবং অবসরের বয়স তিন বছর বাড়িয়ে ৬২ নির্ধারণ করা হতে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
রাষ্ট্র সংস্কারে সরকার যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে, এর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনের প্রধান হয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী। এই কমিশনও বয়সসীমার বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে। এখন সরকারি চাকরিতে প্রবেশে ৩০ আর অবসরের জন্য ৫৯ বছর বয়সসীমা নির্ধারণ করা আছে।
এ ব্যাপারে সরকার-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের সময়সীমা বাড়ানোর বিষয়ে সরকার এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে সরকার জনপ্রশাসন সংস্কারের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করেছে। চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স বাড়াতে সুপারিশ করবে কিনা, তা এ কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত। মূল বিষয়টি হলো, জনগণকে সুশাসন কীভাবে দেওয়া যায়, তা নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে এ কমিশন যদি মনে করে, সরকারি চাকরিতে ঢোকার বয়স ও অবসরের সীমা বাড়ানো প্রয়োজন, তারা সরকারকে সুপারিশ দেবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, অনেক সময় দেখা যায়, একটি গবেষণা কার্যক্রমের জন্য যে অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন হয়, তাতে বয়সসীমা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এসব বাধা উঠিয়ে দেওয়া হবে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রেও অনেক সময় সরকারকে বিশেষজ্ঞ বাইরে থেকে আনতে হয়। সে ক্ষেত্রে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হবে। তা ছাড়া সরকারের নতুন নতুন যে প্রকল্প শুরু হচ্ছে; যেমন– পরমাণু গবেষণা, মহাকাশ গবেষণা; এ ধরনের চাকরির ক্ষেত্রে বয়সসীমা শিথিল করা হবে বলে সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
দশম জাতীয় সংসদে জনপ্রশাসন-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি বয়সসীমা বাড়িয়ে ৬২ বছর করার সুপারিশ করেছিল। নির্বাচনের আগে আগে সেই প্রস্তাব এসেছিল বলে সরকার তখন এ নিয়ে কাজ করেনি। সংসদীয় কমিটি সে সময় অবসরের বয়সসীমা ৫৯ থেকে ৬২ বছর করার প্রস্তাব দিয়েছিল।
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলেছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বর্তমানে ৬৫ বছর এবং উচ্চ আদালতের বিচারকরা ৬৭ বছর পর্যন্ত চাকরি করেন। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ৬৫ বছর দাবি করলেও একবারে চাকরির বয়স ৬৫ বছর করার পরিকল্পনা সরকারের আপাতত নেই। সর্বোচ্চ দুই থেকে তিন বছর বাড়ানো হতে পারে।
বাড়বে বিপুল খরচ
সরকারি কর্মচারীর চাকরির বয়স বাড়লে সরকারের বিপুল খরচ বেড়ে যাবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকারি কর্মচারীর বেতন-ভাতা খাতে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ৮২ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ১৪ লাখ সরকারি কর্মচারীর তিন বছর চাকরি বাড়ালে অন্তত ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে।
মন্ত্রণালয়ের মত চেয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩৫ বছর ও অবসরের বয়স ৬৫ বছর করার দাবি জানিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দেয় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’। চিঠিটি গতকাল বুধবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে পাঠিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
ওই চিঠিতে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স এর আগে যথাক্রমে ৩০ ও ৫৯ (মুক্তিযোদ্ধা কোটাধারীর যথাক্রমে ৩২ ও ৬০) বছর করা হয়েছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বেড়ে বর্তমান ৭২ দশমিক ৩ বছরে দাঁড়িয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের চাকরির অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর এবং সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৭ বছর। এর আগে যেসব চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের অনেকের বয়স ৬৭ বছরের ঊর্ধ্বে।
অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, চাকরিতে প্রবেশের বয়স নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানদণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিশ্বের ১৬২ দেশে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর, কোনো কোনো দেশে আবার এটি উন্মুক্ত। একই সঙ্গে অবসরের বয়সসীমা বিভিন্ন বিভাগভেদে ৬৫ থেকে ৬৭ বছর এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭২ বছর। চাকরিতে প্রবেশ ও অবসরের বয়স বাড়ানোর বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে চাকরিপ্রত্যাশী এবং চাকরিরতদের পক্ষে আন্দোলন ও দাবি উত্থাপিত হয়েছে।
এ ব্যাপারে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, সরকারের বেতনভোগী বিভিন্ন দপ্তরের অবসরের বয়স ভিন্ন ভিন্ন। বৈষম্যহীন দেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এ সরকার যাত্রা শুরু করেছে। বৈষম্য কমাতে ও বাস্তবতার নিরিখে আমরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩৫ বছর ও অবসরের বয়স ৬৫ বছর করার দাবি জানিয়েছি।
আগে কী ছিল
আগে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর। ১৯৯১ সালে তা বাড়িয়ে ৩০ বছর নির্ধারণ করা হয়। আর অবসরের ক্ষেত্রে আগে সরকারি চাকরির বয়স ছিল ৫৭ বছর। ২০১১ সালে বয়স ২ বছর বাড়িয়ে ৫৯ করা হয়।
বয়সসীমা বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি কী
চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশী শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক মো. শরিফুল হাসান শুভ বলেন, দেশের জাতীয় যুবনীতিতে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের যুবক বলা হলেও ৩০ বছর হলেই তাদের সরকারি চাকরিতে আবেদনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, ২৭ থেকে ৩০ বছরে উন্নীত করা হয়, যখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল মাত্র ৫৭ বছর। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে ৭৩ বছর হলেও চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানো হয়নি।
চাকরির আবেদনের বয়স বাড়ানোর আন্দোলনের মুখপাত্র খাদিজা খাতুন মুক্তা বলেন, প্রতিযোগিতার এ সময়ে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিতে ৩০ পেরিয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের কারণে বয়সসীমা একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে আসে। এতে করে কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। দেশে এখন ২৬ লাখ বেকার। তাদের মধ্যে অধিকাংশই বয়সসীমা পার করায় হতাশায় ভুগছেন। বয়সের কারণে অর্জিত সনদ অকেজো হয়ে যাবে, এটা হতে পারে না।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া বলেন, চাকরিতে ঢোকার বয়স ৩০ নির্ধারণ করা আছে মূলত ক্যাডার সার্ভিসের জন্য। এ ছাড়া নবম থেকে ২০তম গ্রেড পর্যন্ত এ বয়স প্রযোজ্য। তবে অনেকেই জানেন না, এর চেয়ে বেশি বয়সেও সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ আছে। সেখানে ৪০, ৪৫ বছর বয়সেও চাকরি মেলে। যারা চাকরির বয়স ৩৫ করতে আন্দোলন করছেন, তারা হয়তো ক্যাডার সার্ভিসের চাকরি ঘিরে আন্দোলন করছেন।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, বিসিএসের জন্য যে বয়স নির্ধারণ করা আছে, সেটিই সঠিক। ৩০-এর বেশি বয়স বাড়ানো ঠিক হবে না। এখন প্রতিবছর বিসিএসের সার্কুলার হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেভাবে সেশনজট নেই। বয়স হঠাৎ বাড়িয়ে দিলে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যাও বেড়ে যাবে, পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা জটিল হবে। এতে যারা বারবার পরীক্ষা দেবেন, তারা অভিজ্ঞতার কারণে পরীক্ষায় ভালো করবেন, চাকরি পাবেন। নতুন যারা চাকরির পরীক্ষা দিতে আসবেন, তাদের মাঝে হতাশা কাজ করবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানো যৌক্তিক। অন্তত দুই থেকে তিন বছর হলেও বাড়ানো উচিত।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, হুট করে কিছু না করে এ বিষয়ে একটি কমিটি বা কমিশন করে খতিয়ে দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো এসব ক্ষেত্রে কত বয়সসীমা নির্ধারণ করেছে, তা বিবেচনায় নিতে হবে।
আশপাশের দেশে কত?
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ভারতে রাজ্যভেদে ও চাকরির ধরন অনুযায়ী আবেদনের বয়সসীমা ভিন্ন। তবে প্রশাসনিক চাকরির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়স ৩২ বছর। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে ৪২, আর অনগ্রসর প্রার্থীর ক্ষেত্রে ৩৫ বছর। সরকারি চাকরির বিভিন্ন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দেশটির ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এ কমিশনের ওয়েবসাইটে ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে (আইএএস) আবেদন করার বয়স উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় আগে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ছিল ৩৫ বছর। ২০২০ সালে দেশটিতে বয়সসীমা বাড়িয়ে ৪০ বছর করা হয়। নেপালে সর্বোচ্চ ৩৫ বছর পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে আবেদনের সুযোগ রয়েছে। তবে নারী ও প্রতি