বঙ্গনিউজ ডেস্কঃ সপ্তাহখানেক ধরে চলছে লোডশেডিং। চলছে ভোগান্তি। তবে শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং হচ্ছে বেশি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় লোডশেডিং বেড়েছে। গ্যাস সংকট ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য প্রায় ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে।
বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎও মিলছে না। তাই লোডশেডিং বেড়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে মানুষ। ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতি হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে সেচ কার্যক্রম। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
বিদ্যুৎ বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দৈনিক প্রায় আড়াই হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং হচ্ছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির (পিজিসিবি) ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, গতকাল সোমবার বেলা ৩টায় ১ হাজার ৮৭৪ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়। গত রোববারও দেশে গড়ে ১ হাজার ২৯১ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়।
জ্বালানি সংকট
মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৩ হাজার ৫৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ আছে। জ্বালানি সংকটে দেশে ৬ হাজার ২৮৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। বিদ্যুতে প্রতিদিন গড়ে ৮৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস দেওয়া হচ্ছে, যা এপ্রিলে ছিল ১৩৫ কোটি ঘনফুট। সামিটের এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। পেট্রোবাংলা প্রতিদিন সরবরাহ করছে ২৫৯ ঘনফুট গ্যাস।
জ্বালানি সংকটের পাশাপাশি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কমেছে। ত্রিপুরা থেকে ঘণ্টায় ১৬০ মেগাওয়াটের স্থানে ৬০ থেকে ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ভেড়ামারা দিয়ে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা থাকলেও মিলছে ৮৮০ মেগাওয়াট। আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও ৪০০ মেগাওয়াট কম আসছে।
পিজিসিবির তথ্যমতে, গতকাল বেলা ৩টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট। আর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১২ হাজার ৭৮৮ মেগাওয়াট। দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার মেগাওয়াট।
ভারতের কোম্পানির পাওনা
টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কাছে ভারতের ৫ বিদ্যুৎ কোম্পানির প্রায় ১০০ কোটি ডলার পাওনা। এই বকেয়ার মধ্যে আদানি পাওয়ার পাবে প্রায় ৮০ কোটি ডলার। ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাহীরা বলেছেন, বকেয়া থাকার পরও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে। তবে সতর্ক করে তারা বলেছেন, এই অবস্থা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। কারণ বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো অংশীদারদের কাছে দায়বদ্ধ।
দেশজুড়ে ভোগান্তি
কুড়িগ্রামে ঘন ঘন লোডশেডিং চলছে এক সপ্তাহ ধরে। এতে সেচ ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। শহরের মজিদা কলেজ মোড়ের ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম গতকাল বলেন, ‘সকাল থেকে বিদ্যুৎ গেছে চারবার। ছবি তোলা ও প্রিন্টের কাজ করতে পারছি না, ক্রেতারা ঘুরে যাচ্ছে।’ পুরাতন থানাপাড়ার রুমা রানী মোহন্ত বলেন, ‘বিদ্যুৎ খুব ঝামেলা করছে। বাচ্চাদের নিয়ে খুব কষ্টে আছি।’
নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) কুড়িগ্রাম কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী জীবন চন্দ্র রায় জানান, শনিবার জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৬৮ মেগাওয়াট। আর বরাদ্দ পাওয়া গেছে ৩৮ মেগাওয়াট। ঘাটতি পূরণে ৮টি ফিডে রুটিন করে লোডশেডিং দিতে হয়েছে।
বিদ্যুৎ থাকছে না সুনামগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে শান্তিগঞ্জের সোহেল তালুকদার জানান, শনিবার রাত ১০টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না। পরে কিছুক্ষণ বিদ্যুৎ পেলেও রাত আড়াইটা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত আবার বিদ্যুৎহীন।
হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে মানুষ। দিনের তুলনায় রাতে লোডশেডিং হচ্ছে বেশি। পল্লী বিদ্যুৎ অফিস জানায়, বানিয়াচং উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৮ মেগাওয়াট। আর পাওয়া যাচ্ছে ৯ থেকে ১০ মেগাওয়াট। উপজেলার নন্দীপাড়ার মহিনুর রহমান বলেন, ‘বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ে জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়েছে।’
রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাওয়ায় গ্রাহকদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। উত্তরের ১৬ জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো মিলে বিদ্যুতের চাহিদা ২ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। কিন্তু দু’দিন ধরে সরবরাহ মিলছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। রংপুর বিভাগের আট জেলায় পল্লী বিদ্যুৎ ও নেসকো মিলে চাহিদা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ মেগাওয়াটের কম বিদ্যুৎ।
রাজশাহী বিভাগে ১ হাজার ৩০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ৮০০ থেকে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সরবরাহ কম থাকায় ঘন ঘন লোডশেডিং দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বগুড়া শহরের রাজাবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক পরিমল প্রসাদ রাজ বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ঠিকমতো বেচাবিক্রি করা যাচ্ছে না। এতে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’ নেসকো সূত্রে জানা যায়, বগুড়ায় বিদ্যুতের চাহিদা ১০৫ মেগাওয়াট। আর জাতীয় গ্রিড থেকে মিলছে ৫০ থেকে ৬০ মেগাওয়াট।
নীলফামারীতে লোডশেডিংয়ে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পকারখানায় উৎপাদন। ছোট ছোট উদ্যোক্তারা পড়েছেন ক্ষতির মুখে। শুধু তাই নয়, লো-ভোল্টেজে ঝুঁকি নিয়ে মিল-কারখানা চালাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক মোটর ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে। ঢেলাপীরের কাদিখোল এলাকার ইকু জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিদ্দিকুল আলম জানান, তাঁর কারখানা থেকে পণ্য রপ্তানি হয় ভারত, নেপাল, ভুটারসহ বিভিন্ন দেশে। দেড় মাস ধরে লোডশেডিংয়ের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে গেছে। ফলে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না।
গাইবান্ধার পাঁচ উপজেলার অনেক এলাকায় রাতে দুই-তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন গ্রাহকরা। পৌর এলাকার গৃহিণী সিদ্দিকা কামাল নাজু বলেন, ‘লোডশেডিংয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। গরমের কারণে রাতে ঘুমাতেও পারি না।’ শহরের ব্রিজরোড এলাকার ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী তৈয়ব মিয়া বলেন, ‘বিদ্যুতের ওপরই আমাদের ব্যবসা। বিদ্যুৎ ঠিকমতো না পাওয়ায় ব্যবসা করতে পারছি না।’ নেসকো গাইবান্ধার নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুর রহমান জানান, চাহিদার তুলনায় তিনিও বিদ্যুৎ পাচ্ছেন কম। তাই ঘাটতি পূরণে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
ঢাকার দুই বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি ডিপিডিসি ও ডেসকোর তথ্য বলছে, গতকাল ঢাকায় বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল ৪০০ মেগাওয়াট। পরিস্থিতি সামলাতে ডেসকোকে অঞ্চলভেদে ৩ থেকে ৪ বার লোডশেডিং করতে হয়। ডিপিডিসির এলাকায় দুই থেকে তিনবার লোডশেডিং হয়। সেগুনবাগিচার বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন জানান, গতকাল দুপুর পর্যন্ত দুইবার বিদ্যুৎ যায়। একবার এক ঘণ্টা আরেকবার দেড় ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎ ছিল না। মিরপুরের বাসিন্দা সোনিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘একটু পর পর লোডশেডিং না দিয়ে একটা দিলে ভালো হয়।’
(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অফিস এবং জেলা ও উপজেলা প্রতিনিধি)