দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণার পরম উৎস হিসেবে লিখলেন – “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।”
এই চরণ দুটিই যেন এখন এক টুকরো বাংলাদেশ। চরণ দুটিই যেন দেশের বর্ণনা, রূপ, বৈচিত্র্য আর অলংকারের সারাংশ। অথচ আমাদের জন্মভূমিতেই “ফেইস শো” এর লড়াই চলছে। সেটি কি আমরা চক্ষু মেলিয়া দেখছি?
আপনার উত্তর হতেই পারে– রবীন্দ্রনাথের স্ফুলিঙ্গের সেই বাণী– “দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া…
কিন্তু আপনি বিজ্ঞজন, সাধু, পণ্ডিত ব্যক্তি। চক্ষু মেলিয়া দেখুন– দেশে কি চলছে?
তিক্ত হলেও সত্যি যে–
* আমরা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে ছবি না তুললে আমাদের খাবার হজম হয় না।
* দুর্যোগের সময়গুলোতে মানুষকে সহায়তার নামে প্রচার প্রচারণা না করলে সেই ব্র্যান্ড বা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা ষোল কলা পূর্ণ হয় না।
* ঈদ বা বিভিন্ন উৎসবমুখর দিনগুলোতে নতুন পোশাক পড়ে ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় না দিলে ঈদ পরিপূর্ণই হয় না।
* কোন দর্শনীয় জায়গায় গিয়ে চোখ দিয়ে প্রকৃতিকে অনুভব না করে, ফোনে ছবি তুললেই কেবল কার্য সিদ্ধ হয়। তা ব্যতীত ভ্রমণের তৃপ্তিই আসে না।
অথচ বনফুলের নিমগাছ গল্পে কবি নিমগাছ দেখার পরে অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিল দীর্ঘক্ষণ। কথা বলেন নাই। ছবি তোলেন নাই।
এসব পড়ার পর কেউ হয়তো আমার চক্ষে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিবেন– তুমি কি দেখো না? দিনের পর দিন মানুষ সভ্য হচ্ছে, আধুনিক থেকে আধুনিকতার ছোঁয়া পাচ্ছে। আধুনিক যুগে একটু-আট্টু এসব না করলে হয় নাকি?
এমন সব প্রশ্নের উত্তরে বলাই যায়– “অল দ্যাট গ্লিটারস্ ইজ নট গোল্ড” অর্থাৎ “চকচক করলেই সোনা হয় না”। অবশ্য চাষার দুক্ষু প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া সুন্দর করে উত্তর দিয়েছেন– “সভ্যতা শিরায় শিরায়, ধমনীতে ধমনীতে প্রবেশ করিয়া আমাদেরকে বিষে জর্জরিত করিয়া ফেলিয়াছে। ঐ যে “পাছায় জোটে না ত্যানা” কিন্তু মাথায় ছাতা এবং সম্ভবত পায়ে জুতা আছে তো! “বৌ-এর পৈছা বিকায়” কিন্তু তবু “বেলোয়ারের চুড়ি” থাকে তো! মুটে মজু”।
জ্ঞানী-গুণী মানুষ কখনো নিজেকে সবার সম্মুখে জাহির করতে আসে না। তাঁর জ্ঞানের অসীমতাই তাঁকে একটা সময় সবার সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। পরিচয় করিয়ে দেয়। সম্মান এনে দেয়।
সে জন্যেই পন্ডিতদের মুখে শুনতে পাওয়া যায়–”যে যত বেশী জ্ঞানী, সে তত বেশী বিনয়ী হয়”। জ্ঞানী’রা আসলেই বিনয়ী হয়।
“শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখা যায় না” একইভাবে মিথ্যা দিয়ে সত্য কে লুকিয়েও রাখা যায়
না। আবার যে যোগ্য তাঁকে বল প্রয়োগ করে দমিয়েও রাখা যায় না।
এই অতি সাধারণ ব্যাপারগুলো আমাদের মগজে ঢোকে না। ফলশ্রুতিতে– দেশে অনেক সময় ক্ষমতা, দল এবং বলের কারণে– গাধার দলে বাছুরকে প্রামানিক গিরি করতে দেখা যায়।
একবার,
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অবসর প্রাপ্ত প্রফেসরের বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। স্যারের বয়স সত্তরের কাছাকাছি – এখনো নিয়মিত বই পড়েন। আমি অবাক হয়েছিলাম।
বিদায় নিয়ে আসার সময়– মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, “সব সময় বিনয়ী থাকবে। বই পড়বে। বইয়ের থেকে ভালো সহপাঠী দ্বিতীয়টি আর হয় না।” স্যার একটি বই আমাকে দিয়েছিলেন। আমি সত্যি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আজো স্যারকে আমার হরহামেশাই মনে পড়ে– বই দিয়েছিলেন বলে নয়। স্যারের কথায় মধু ছিল। জ্ঞানের সমুদ্র ছিল।
সুতরাং বলাই যায়– জ্ঞানী, পণ্ডিত ব্যক্তিদের জনসম্মুখে ফেইস শো এর দরকার পড়ে না। তাঁদের কথা, কর্মই বলে দেয়– তিনি কেমন?
অর্থাৎ “ব্যবহারে বংশের পরিচয়।” আর যাঁরা নিজেদের প্রদর্শন করে কার্য হাসিল করতে চায়, প্রকৃত পক্ষে তাঁরা ফেইক, মিথ্যা। অর্থাৎ “খালি কলসি বাজে বেশি”।
ফেইস ভ্যালুর সাথে সাথে তৈল ব্যবহারটাও আমাদের অস্থিতে অতঃপর ভাবে মিশে আছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে– “এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর অন্য তৈলে মন ফেরে।”
আমি মূলতঃ মন ফেরে এমন তৈলের কথাই বলছি।নিজে যোগ্য না হয়ে তৈল দিলে সেই তৈলে কাজ হলেও নিজের মনের কাছে অপূর্ণতার একটি ছাপ রয়ে যায়। সে তৈল সারাজীবন অপরাধী করে দেয়। চোরের তালিকায় নাম তুলে দিয়ে অসুখী করতে বাধ্য করায়।
আমাদের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে এগুলো উপলব্ধি করতে হবে। সময় থাকতে সময়ের কাজ করতে হবে। অন্যথায় লালন ফকিরের ন্যায়– “সময় গেলে সাধন হবে না।”
আমরা যে দিন ফেইস ভ্যালুর থেকে পরোপকারকে এবং তৈলের চেয়ে সত্যকে বেশি প্রায়োরিটি দিতে পারবো। সেদিনই কেবল কুসুমকুমারী দেবীর চাওয়া সেই মানুষ টা হতে পারবো। “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।”
মোঃ শামীম রেজা
শিক্ষার্থী,ইংরেজি বিভাগ, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।