বঙ্গনিউজ ডেস্কঃ বন্যাদুর্গত এলাকায় বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ও বিভিন্ন সংগঠন। গত ২১ আগস্ট ভারত থেকে উজানের পানি এসে নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা ভাসিয়ে দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ রওনা দিতে থাকে মানুষকে বাঁচানোর তাগিদে। পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ অভিনবভাবে ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ত্রাণ সংগ্রহের বিভিন্ন আহ্বান এবং কৌশল।
সর্বস্তরের মানুষও এতে এগিয়ে আসে। যে যার মতো করে সাহায্যে এগিয়ে আসে। একজনকে দেখে অন্যজনও উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেছে অধিকভাবে।
শিশু থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ যে যেভাবে পারে ত্রাণ সংগ্রহের জন্য মাঠে নেমেছে।
শিশুও তার জমানো টাকা বন্যার্তদের জন্য দিচ্ছে। পেশাজীবীরা তাঁদের উপার্জনের অংশ দিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁদের এক বেলা খাবারের টাকা দিচ্ছেন। দিনমজুর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের এগিয়ে আসার এমন চিত্র এর আগে কখনো দেখেছি কি না আমার মনে পড়ে না।
এই বন্যায় মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে নজির দেখেছি, তা সত্যি এক নতুন বাংলাদেশ গঠনের শুভ লক্ষণ হিসেবে অনুমান করা যাচ্ছে। দেশের মানুষ দেখিয়েছে যে তারা যেকোনো জাতীয় সমস্যা ঐক্যবদ্ধ হয়েই মোকাবেলা করবে এবং করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) প্রাঙ্গণে চলছে ত্রাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ। প্রবেশপথের পাশে ‘গণত্রাণ সংগ্রহ’ বুথ বসানো হয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে সাধারণ মানুষ এসে নগদ অর্থসহ নানা ধরনের ত্রাণ সেখানে দিয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই ফান্ড এবং ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম চলমান রেখেছে। তবে লক্ষ করা গেছে, অনেকেই অল্প কিছু ফান্ড বা ত্রাণ সংগ্রহ করে বন্যাদুর্গত এলাকায় যাচ্ছে। এতে বন্যার্তদের সাহায্যের একটি বড় অংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ট্রান্সপোর্টে বা অন্যান্যভাবে। এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবকরা কৌশলী হলে সব ফান্ড এবং ত্রাণ যথাযথভাবে কাজে লাগনো যাবে বলে আশা করা যায়। এই মুহূর্তে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যে বা যারা ত্রাণ সংগ্রহ করছে, তাদের একটি কাঠামোগত অবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। যেহেতু এই বন্যার প্রভাব সামনে আরো অনেক দিন থাকবে, সেহেতু এ বিষয়ে একটি সুন্দর পরিকল্পনায় বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে সহজ হবে। আমরা জানি, ইউনিয়নকাঠামোর মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি আছে। তরুণদের সম্পৃক্ত করে সেই কাঠামোকে কাজে লাগাতে হবে। না হলে এত বড় দুর্যোগ মোকাবেলা করা কঠিন হবে।
আমরা মনে করি, এসব ত্রাণ বিতরণ কর্মে যথাযথ সমন্বয় না থাকলে বহু মানুষের দুর্গতি বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ অভিজ্ঞতা বলে, সমন্বয়হীন ত্রাণ বিতরণে সাধারণত কেউ কেউ বেশি সুবিধা পায়, অন্যরা বঞ্চিত হয়। ফলে উদ্ধার কার্যক্রম শুধু নয়, ত্রাণ সহায়তা বৃদ্ধির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এ কাজে সমন্বয় নিশ্চিত করাও জরুরি।
বন্যার কারণ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা ও সমালোচনা দেখা যাচ্ছে। কেউ বলছে, আবহাওয়া দপ্তর পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ বলছে, যৌথ নদী কমিশনের নিষ্ক্রিয়তার কারণে বাংলাদেশ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারেনি। কিন্তু এসব কারণ অনুসন্ধান কিংবা ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে পরে ভাবা যাবে। এখন জরুরি হলো বন্যাদুর্গত মানুষকে উদ্ধার করা, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। পানি নেমে গেলে হতাহতের সংখ্যা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করার দিকে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে।
সরকার এবং সাধারণ জনগণের সংগ্রহকৃত পর্যাপ্ত পরিমাণ অনুদান ঠিকই আছে, কিন্তু এসব অনুদান যথাযথভাবে বণ্টনের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। এর আগে দেখা গেছে, সরকারের ত্রাণ চুরি ও অব্যবস্থাপনার ফলে আক্রান্তরা এর যথাযথ সুফল ভোগ করতে পারে না।
আসলে এমন ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অঞ্চলভিত্তিক কোনো সুনির্দিষ্ট ডাটাবেইস নেই। মোট জনসংখ্যার পেশা, বয়স, আয়, পারিবারিক নির্ভরশীলতা প্রভৃতি বিবেচনায় নির্দিষ্ট একটি ডাটাবেইস দেশের যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে কতসংখ্যক জনসাধারণ চাকরিজীবী (পেশাভিত্তিক আলাদা), গাড়িচালক, রিকশাচালক, চায়ের দোকানদার, ফুটপাতের হকার, কৃষক-শ্রমিক, কুলি, মজুর, পোশাক কারখানার কর্মী, মিল-কারখানার কর্মী, ব্যবসায়ী (ধরন অনুযায়ী) প্রভৃতির যথাযথ তালিকা কিংবা ডাটাবেইস আজ পর্যন্তও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। হয়তো এ বিষয়ে পরিসংখ্যান আছে, কিন্তু পরিসংখ্যান আর ডাটাবেইস এক নয়। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে কোনো কিছু অনুমান করা যায়। তবে ডাটাবেইসের ভিত্তিতে যেভাবে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব, সেটি তথাকথিত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনসাধারণ, যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের সুনির্দিষ্ট তথ্য সরকারের কাছে থাকা দরকার। একটি পরিবারে, একটি মহল্লায়, একটি পাড়ায়, একটি গ্রামে, একটি ইউনিয়নে, একটি শহরে, একটি উপজেলায়, একটি পৌরসভায়, একটি সিটি করপোরেশনে এবং একটি জেলায় আলাদা ইউনিটে কতসংখ্যক মানুষ, নিম্ন আয়ের মানুষ এবং উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত রয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য কিংবা ডাটাবেইস থাকলে সংকটকালীন ত্রাণ কর্মসূচি আরো বেশি গঠনমূলক এবং কার্যকর হওয়ার সুযোগ থাকে। অনেক সময় একজন একাধিকবার ত্রাণ গ্রহণ করছে, আবার অনেকে মোটেও পাচ্ছে না। উল্লেখ্য, প্রতিবছরই আমাদের দেশ ছোট-বড় কোনো না কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হয়। বিশেষ করে বন্যা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থাকেই। ফলে সরকারকে মাঠ পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণে কাজ করতে হয়।
একটি রাষ্ট্রে কত জনসংখ্যা বসবাস করে, কার নাম কী, কার মাসিক আয় কত, কার পেশা কী—এ বিষয়ে একটি ডাটাবেইস করা কঠিন হলেও কাজটি একেবারে অসম্ভব নয়। দেশের বিভিন্ন বাহিনীর সহযোগিতায় দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে এই কাজটি একবার সম্পন্ন করতে পারলে নানা দুর্যোগের মুহূর্তে সরকারের যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রম এবং দুর্যোগকালীন যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ সহজ হবে। এমনকি বিদ্যমান স্মার্ট কার্ডের (জাতীয় পরিচয়পত্র) ব্যাপ্তিকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়