বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনটি গুণ বিচারে কৃশকায় হয়ে যাচ্ছে। একটি দেশের রাজনীতির প্রতি যদি সাধারণ মানুষের আস্থা কমতে থাকে, তবে এর চেয়ে ভয়ংকর সংবাদ জাতির জন্য আর কিছু হতে পারে না। জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে, ভারসাম্য রক্ষা করার মতো বিকল্প রাজনৈতিক দলের ভীষণ খরা চলছে এদেশে। রাজনৈতিক দলের বিকাশে নেতৃত্ব ও আদর্শ বড় কথা। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে এ দুই বৈশিষ্ট্যের সংকট তীব্র হচ্ছে। বাম দলগুলো টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এখন বক্তৃতার মঞ্চে কণ্ঠশীলন ছাড়া দেশ-জাতির কল্যাণে এ দলগুলো উল্লেখ করার মতো কোনো অবদান রাখতে পারছে না। সম্ভাবনা থাকার পরও জাতীয় পার্টি জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। কোনো কোনো পুরোনো নেতা নিজ দলে পদ-পদবি না পেয়ে, নতুন দল তৈরি করে দাঁড়াতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু দ্রুত কিছু প্রাপ্তির আশায় বিতর্কিত দলে যোগ দিয়ে মানুষের সামনে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা কঠিন হয়ে পড়ছে তাদের। জামায়াতে ইসলামী দলটির সমর্থকগোষ্ঠী থাকার পরও ভ্রান্ত আদর্শের কারণে পাকিস্তান আমল থেকেই শক্ত মেরুদণ্ড নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তাই কোনো পর্বেই নির্বাচনে এককভাবে দাঁড়িয়ে মানুষের সমর্থন পায়নি এ দলটি। অন্যদিকে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত অবস্থান এমনিতেই তাদের ব্যাকফুটে ছুড়ে ফেলেছে।তাই এখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলই দৃশ্যমান এদেশে। বিএনপির দুর্ভাগ্য, বিশাল জনসমর্থন থাকার পরও নেতৃত্বের সংকট, অতীতের নানা ভুল সিদ্ধান্ত এবং নেতাদের একঘেয়ে বক্তৃতা-বিবৃতিতেই যেন আটকে আছে দলটি। মঞ্চে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি উচ্চারিত হলেও গণতন্ত্রের চর্চা নেই দলের ভেতর। এমন বাস্তবতায় ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের পক্ষে গণতান্ত্রিক শক্তিতে শানিত হয়ে জনমন-নন্দিত হয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর গড়া এ দলটি, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দলটিও এখন নেতৃত্ব ও আদর্শের সংকটে ধুঁকছে, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র অধরাই থেকে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু-উত্তর নেতৃত্বের শূন্যতা পূরণে জননেত্রী শেখ হাসিনার উত্থান ও দৃঢ় অবস্থান আশাবাদী হওয়ার পথ তৈরি করেছিল। কিন্তু রাজনীতির মাঠে অনেকটা তিনি একা। এমন দুস্তর পথে তো কেউ একা হাঁটতে পারে না। তাই ঘিরে থাকা অস্বচ্ছ পরিবেশের সঙ্গে আপস করেই এগোতে হচ্ছে। ফলে সব সময় স্বাভাবিক ছন্দে হাঁটা যাচ্ছে না। ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে গিয়ে সরল ও গণতান্ত্রিক পথে হাঁটতে পারছে না এ দলটিও। ফলে রাষ্ট্রের সব শিরা-উপশিরা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এমন রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আশঙ্কা হচ্ছে, অন্ধকারে ঘাপটি মেরে থাকা অশুভ শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এসব বাস্তবতায় সাধারণ-সচেতন মানুষ এখন ভয়ানক অস্বস্তি ও হতাশায় নিপতিত হচ্ছে।
রাজনীতির মাঠে আইকনের তালিকা ক্রমে ছোট হয়ে যাচ্ছে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধুর মতো অভ্রভেদী নেতৃত্বের পর নিরঙ্কুশ জনকল্যাণকামী জননেতা পাওয়া যাচ্ছে না কেন? এ তালিকায় নিশ্চয়ই জননেত্রী শেখ হাসিনার নাম যুক্ত হবে।কিন্তু তীব্রভাবে দলতন্ত্রে আটকে থাকায় ইতিহাস শর্তহীনভাবে আসন দেবে কি না এ নিয়ে কারও কারও মনে সন্দেহ থাকতেও পারে। বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত নেতা হওয়া খুব সহজ নয়। তারপরও আওয়ামী লীগে নেতৃত্বের অভাব শেখ হাসিনার মধ্য দিয়ে পূরণ হয়েছে। এরপরই তো এক বিশাল শূন্যতা।জননেত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনকালের উজ্জ্বল দিক হচ্ছে, সাহসিকতার সঙ্গে উন্নয়নের পথে হাঁটা। এক্ষেত্রে সাফল্যও বিস্ময়কর। পাশাপাশি সুশাসনের পথে হাঁটতে না পারার ব্যর্থতাও তো রয়েছে। নানা সংকটের মধ্যে দুর্নীতি এখন মহাসংকট হিসাবে দেখা দিয়েছে। বিএনপির শাসনামলে আমরা দুর্নীতির মহাভারত রচিত হতে দেখেছি। এক-এগারোর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তা বিশেষভাবে উন্মোচিত হয়েছিল। আমাদের দেশে বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলো একে অন্যকে টপকে জিততে চায়। দুর্নীতির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনকালে সব স্তরে দুর্নীতির মচ্ছব শুরু হয়ে গেছে।নানা ধরনের প্রশ্রয় থাকায় দুর্নীতিবাজরা এখন দু’টাকা দুর্নীতি করে থামছে না। তাদের লাগছে দুই মিলিয়ন। দুর্নীতির অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দুপাশে হাত খুলে দাঁড়ালে কোনো না কোনো দুর্নীতিবাজের গায়ে ছোঁয়া লাগবেই। এ কারণেই সরকারের যেসব সংস্থা দুর্নীতি দমনে ভূমিকা রাখছে, তাদের সাফল্য দেখা যাচ্ছে না। সরষের ভেতরেই এখন ভূতের আনাগোনা বেশি। সম্প্রতি সাহসী হয়ে গণমাধ্যম বড় দুর্নীতিবাজদের কয়েকজনের স্বরূপ উন্মোচন করেছে। এতে বাধ্য হয়েই যেন সক্রিয় হতে হচ্ছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে। এসব দেখে স্বাভাবিকভাবেই অস্বস্তি তৈরি হওয়ার কথা সরকারের ছায়ায় থাকা ঘাপটি মারা অন্য দুর্নীতিবাজদের।সম্প্রতি ছাত্রদের কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে সচেতন মানুষ নিরীহ গোছের আন্দোলন বলেই মনে করছে। এর সহজ নিষ্পত্তি করা সরকারের জন্য কঠিন বলে মনে হয়নি। কিন্তু সরকার সে পথে না হেঁটে জটিল করে তুলছে কেন? এর পেছনে কারণ খুঁজছে মানুষ। সরকার আদালতের সিদ্ধান্তের কথা বললেও আদালত তো স্পষ্ট করেই দিয়েছেন-সরকার চাইলে কোটা সংস্কার করতেই পারে। কিন্তু আমরা কী দেখছি? কিছু সময় ঠান্ডা মাথায় আন্দোলন পর্যবেক্ষণ করার পর এখন সরকারি নেতাদের কিছুটা ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। ছাত্রদের সন্তানের মতো না দেখে হুমকি-ধমকি পর্ব শুরু হয়ে গেছে।ছাত্রলীগের কণ্ঠকে সক্রিয় করা হচ্ছে। কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে পুলিশও ধমক দিচ্ছে। কোনো কোনো সিনিয়র মন্ত্রীও এই কোমলমতি ছাত্রদের ভেতর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনা খুঁজছেন। ইতোমধ্যে রাজনৈতিক বক্তৃতাও শুরু হয়ে গেছে। নেতারা চিন্তা করছেন না, দিন ক্রমে পালটে যাচ্ছে। ১১ জুলাই রাতে টেলিভিশনে কোটাবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত এক ছাত্রীর মুখে অমোঘ সত্য শুনলাম।ছাত্রলীগের হুমকির সূত্রে সে বলল, ‘ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রলীগের প্রতি কোনো সমর্থন নেই। ওরা শুধু সরকারের দালালি করে।’ এমন বাস্তবতায় ছাত্রলীগকে লাঠিয়াল হিসাবে ব্যবহারের পরিণতি ভালো নাও হতে পারে। ছাত্রলীগের অধিকাংশ কর্মীই জানে কোটাবিরোধী আন্দোলন তাদেরও স্বার্থ সংরক্ষণ করে। এখন তো সাধারণ মানুষ বলাবলি শুরু করেছে, যে আন্দোলন শুরুতেই নিষ্পত্তিযোগ্য ছিল, তাকে সরকারই পেলেপুষে বড় করছে। কারণ, এখন মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানো প্রয়োজন। ক্ষমতাবান দুর্নীতিবাজরা তাতে কিছুটা স্বস্তি পাবে। কিন্তু তাদের জানা উচিত, কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে বেশিদিন সত্যকে আড়াল করা যায় না। মাঠে আন্দোলন করে বেড়ে ওঠা দল আওয়ামী লীগ। আন্দোলনের গতি প্রকৃতি এ দলের নেতাদের বেশি বোঝার কথা। সেখানে কেন স্বৈরাচারী শাসকদের মেজাজ তাদের মধ্যে কাজ করছে, তা ঠিক স্পষ্ট নয়। মহামান্য আদালতই তো এখন সরকারের হাতে নিষ্পত্তির দায়িত্ব দিয়েছেন। সুতরাং রাজনৈতিক কথার মারপ্যাঁচে পরিস্থিতি জটিল করে তোলাটা সরকারের জন্য সুবিবেচনাপ্রসূত আচরণ হবে বলে মনে হয় না। বরং শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নেওয়াটা হবে সরকারের দায়িত্ব। তা না হলে সমুদয় ক্ষতির দায় সরকারকেই বহন করতে হবে। যে সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে, সে সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের এনালগ মার্কা অতি পুরোনো বক্তব্য সাধারণ মানুষকে কি ছুঁয়ে যাবে? তাদের বোঝা উচিত, সারা দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এ আন্দোলন সমর্থন করছে। তাই আন্দোলনের যৌক্তিক সমাধানের পথ না খুঁজে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়া খুব ভালো সংকেত দিচ্ছে না।কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সততাকে আমলে না নিয়ে বিরোধী দলের উসকানি বলে চালানো হচ্ছে। শুরু থেকে তো উসকানির আলামত ছিল না। এখন বিএনপি সমর্থন দিচ্ছে। আজকে বিএনপির জায়গায় আওয়ামী লীগ থাকলে তারাও এ কাজটিই করত। রাজনৈতিক সুবিধা সবাই নিতে চায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে সবিনয়ে প্রশ্ন করতে চাই, এতই যদি জানেন, তবে এ মওকা বিএনপিকে দিচ্ছেন কেন? বিএনপি নাক গলানোর আগে তা নিষ্পত্তি করা কি খুব কঠিন ছিল?দীর্ঘকাল মাঠের রাজনীতি করা আওয়ামী লীগের নেতাদের আমাদের মতো রাজনীতি-অজ্ঞ মানুষের বলা সাজে না, তবুও বলছি-সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা অহিংস আন্দোলনই চালিয়ে যাচ্ছে। ধমকে বা প্রলোভনে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের নিবৃত্ত করা গেলেও ছাত্রদের ক্ষেত্রে এর উলটো ফল ফলে। তাই বলব, আত্মচৈতন্যে সবার ফিরে আসা উচিত।একটি অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করব। একবার বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। প্রথম সারিতে বসা ছিলেন প্রথিতযশা এক অধ্যাপক; বর্তমানে প্রয়াত আমার সেই শিক্ষক। পাশের চেয়ারে শ্রদ্ধেয় জামিলুর রেজা চৌধুরী (প্রয়াত)। তার পাশে এশিয়াটিক সোসাইটির তখনকার সভাপতি এক সময়ের ডাকসুর ভিপি অধ্যাপক মাহফুজা খানম। আমার সেই শিক্ষক বরাবরই চাননি আমি পত্রিকায় কলাম লিখি। স্যার সেদিনও শাসন করলেন। মাহফুজা আপা আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন। আমার কলামের পাঠক তিনি; দেখা হলে উৎসাহ দেন। তিনি স্যারের কথা মানতে পারলেন না।বিচার চাওয়ার মতো করেই রায় জানতে চাইলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর কাছে। স্যার তার স্বভাবসুলভ শান্ত ভঙ্গিতে পশ্চিমা দুনিয়ার দুজন বিখ্যাত অধ্যাপকের নাম বললেন। যারা নিয়মিত পত্রিকায় কলাম লিখতেন। রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিজ্ঞ মানুষেরা সেসব কলামের জন্য অপেক্ষা করতেন। কারণ সবাই চাইতেন এখান থেকে দিকনির্দেশনা পেতে। আর আমাদের দেশে বিষয়টি অনেকটা উলটো। আমার এক প্রাজ্ঞ বন্ধু বলতেন, তোমাদের সত্য কথা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পড়ার সময় নেই আমাদের দেশের ক্ষমতাবানদের। আর পড়লেও পক্ষে গেলে নিজেদের লোক মনে করবে, আর বিপক্ষে গেলে অমুক দলের এজেন্ডা পূরণ করছে ভাববে। তাছাড়া আমাদের দেশের নেতা-নেত্রীরা নিজেদের সর্ববিষয়ে অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী মনে করেন।অন্যের পরামর্শ কেন নেবেন তারা? আমি বিনয়ের সঙ্গে বন্ধুকে বলেছিলাম, আমি কখনো এ বিজ্ঞদের লেখক হতে চাই না। আমি লিখি সাধারণ পাঠকের জন্য। যেহেতু ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার বিষয় নেই, তাই কাউকে খুশি না করে সত্যের পক্ষে জনমত গঠনের চেষ্টাই আমার লক্ষ্য। মানুষের সচেতনতা বাড়লে তারা ন্যায়ের পক্ষে আওয়াজ তুলবেই। তখন ক্ষমতাবানরা বাধ্য হবেন সরল পথে ফিরে আসতে; বাধ্য হবেন গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করতে।
এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
তথ্যসূত্রঃ যুগান্তর