১৮৮৬ সনের ৭ মে। কবিগুরু সে বছর ২৫ বৈশাখ ২৫ বছর পূর্ণ করলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে কোথাও কোন জন্মদিনের অনুষ্ঠান হয়নি। যে কবির জন্মদিন এতো ঘটা করে দেশে-বিদেশে পালিত হয়,তা কবির পঁচিশতম জন্মদিন পর্যন্ত কিন্তু পালিত হয়নি কোথাও। রজত জয়ন্তী পূর্ণ করলেন কবি। কিন্তু জন্মদিন হয়নি। তবে সেদিন কবিগুরু নিজেই প্রথম উত্থাপন করলেন তাঁর জন্মদিনের কথা। শীর্শ চন্দ্র মজুমদারকে প্রথম লিখে জানিয়ে ছিলেন যে, “ আজ আমার জন্মদিন। পঁচিশে বৈশাখ। পঁচিশ বছর পূর্বে এই পঁচিশে বৈশাখ আমি ধরণীকে বাধিত করতে অবতীর্ণ হয়েছিলুম। জীবনে এমন আরও অনেকগুলো পঁচিশে বৈশাখ যেন আসে এই আশীর্বাদ করুন। জীবন অতি সুখের ।”
ক্ষণজন্মা এই মহান কবির জন্মদিন পালিত না হওয়াটা একটা বিস্ময়কর বটে। সে সময় ঠাকুর বাড়িতে কোন জন্মদিন পালিত হতো না। কারণ তাঁরা ছিলেন ব্রাহ্ম সম্প্রদায় ভুক্ত। ব্রাহ্ম সম্প্রদায় ভুক্তদের পূজার কোন অনুষ্ঠান পালন করা হয়না। তিথি পূজাও নয়। কবিগুরুর ভাগ্নী, স্বর্ণ কুমারী দেবীর মেঝ কন্যা সরলা দেবী লিখেছেন, “ ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েদের জন্মতিথি পূজার অনুষ্ঠান না থাকায় আমরা কে যে কবে জন্মেছি তার ধার ধারতুম না। আমাদের জন্মের তারিখ তিথি ঠিকুজি বা কুষ্ঠিতে তুলা থাকতো, লোকের মনে বছর বছর তুলে ধরা হতো না। বিলেত ফেরতা মেজ মামী যে, জন্মদিন করাতে লাগলেন তা তিথি পূজার মতো নয়। বিলিতি রকমের। তাঁর ছেলেমেয়েদের জন্মদিনে বাড়ি শুদ্ধ সকলকে বৈকালিক জলযোগে নিমন্ত্রন্ন করতেন। আর প্রতি ঘরের ছেলেমেয়েরা হাতে কিছু উপহার নিয়ে আসতো”। ঠাকুর বাড়ির এই ব্যবস্থাটি পাল্টে দিয়ে ছিলেন জ্ঞানদা নন্দিনী দেবী। তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। বিলেত থেকে ফিরে এসে নিজের মেয়ে ইন্দিরা দেবীর জন্মদিন পালন করলেন। তাও জন্মদিনের পূজার তিথি টুকু বাদ দিয়ে শুধু মাত্র আপ্যায়ণ এবং হৈচৈয়ের মাধ্যমে পালিত হলো ইন্দিরা দেবীর জন্মদিন। এই ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন সরলা দেবী। এভাবেই ঠাকুর বাড়িতে পালিত হচ্ছিল জন্মদিন,তবে কবিগুরুর নয়। পরে এসে গেল ১৮৮৭ সালের ৭ ই মে। কবিগুরুর জীবনের ২৬টি বছর পার করে ২৭শে পদার্পণ করলেন। সে বছরই প্রথম পালিত হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। পালন করলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই ভাগ্নী সরলা দেবী। সরলা দেবী জানিয়েছেন, তিনি (রবীন্দ্রনাথ) ও নতুন মামা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থাকেন মেজ মামীর সঙ্গে, পার্ক স্ট্রীটে। রবী মামার জন্মদিন প্রথম আমিই করাই। অতি ভোরে উল্টো ডিঙ্গির কাশিয়া বাগান বাড়ি থেকে পার্ক স্ট্রীটে নিঃশব্দে তাঁর ঘরের তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে আনানো বেলী ফুলের মালার সঙ্গে অন্যান্য ফুল ও এক জোড়া ধূতি-চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকে জাগিয়ে দিলুম। তখন আর সবাই জেগে উঠলেন- রবীর জন্মদিন বলে একটি সাড়া পড়ে গেল। সেই বছর থেকে তাঁর জন্মদিনের উৎসব আরম্ভ হলো। কবির তখন বয়স ২৭ বছর।
( চলবে )