বঙ্গনিউজঃ শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার মো. মাইন উদ্দিনসহ ৪২ জনকে ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল চাকরিচ্যুত করে ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশন। মাইন উদ্দিন হাইকমিশনে ২০০৬ সাল থেকে আবাসিক নিরাপত্তা প্রহরী পদে কর্মরত ছিলেন। সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী পাওনা পরিশোধ না করায় তারা ২০১৭ সালে ঢাকার ১ নম্বর শ্রম আদালতে মামলা করেন। পরে ২০১৯ সালে তাদের চাকরিচ্যুতি বেআইনি ঘোষণা করে রায় দেন শ্রম আদালত। রায়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী মাইন উদ্দিনসহ সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের নির্দেশ দেন আদালত। এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে ব্রিটিশ হাইকমিশন, যা এখনও বিচারাধীন।
এ প্রসঙ্গে বর্তমানে ঢাকার বারিধারায় একটি আবাসিক ভবনে কর্মরত মাইন উদ্দিন বলেন, ছোট পদে চাকরি করেও হয়রানির শিকার হচ্ছি। সাত বছর ধরে আদালতের বারান্দায় ঘুরছি। এখন শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালই শেষ ভরসা।
২০১৭ সালের আগস্টে মানবাধিকার সংগঠন ব্লাস্টের মৌলভীবাজারের জেলা সমন্বয়কারী পদে নিয়োগ পান চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ উপজেলার এ কে এম মাহাতাব উদ্দিন। ২০১৮ সালের মে মাসে কর্ম-এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। পরে তিনি তাঁর চিকিৎসার ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য ব্লাস্টে লিখিত আবেদন করেন। কিন্তু এ পর্যায়ে তাঁকে দুই মাসের নোটিশ দিয়ে চাকরিচ্যুত করে প্রতিষ্ঠানটি। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চাকরি পুনর্বহালের নির্দেশনা চেয়ে শ্রম আদালতে মামলা করেন তিনি। ২০২১ সালে ওই মামলার রায়ে শ্রম আদালত বলেন, বাদী শ্রমিক নন; তাই শ্রম আইন অনুযায়ী কোনো প্রতিকার পাওয়ার উপযুক্ত নন।
এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন মাহাতাব উদ্দিন। তিনি বলেন, এটি একটি অভিনব রায়। আইন অনুযায়ী সবাই শ্রমিক। এ জন্য শ্রম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু হাইকোর্ট আগে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এরপর শ্রম আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলেও সেটি তিন বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
শুধু মাইন উদ্দিন ও মাহাতাব উদ্দিন নন; তাদের মতো হাজারো শ্রমিকের ২১ হাজার ৬১টি মামলা বিচারাধীন দেশের ১৩টি শ্রম আদালত ও একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও গাজীপুরে শ্রম আদালত রয়েছে। আর একটি মাত্র শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল, সেটি ঢাকায় অবস্থিত। দেশে সব জেলায় শ্রম আদালত না থাকায় অন্যান্য জেলার শ্রমিকদের ভোগান্তি আরও বেশি। কারণ, মামলাজট ও কখনও বিচারক-শূন্যতায় তাদের বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরপাক খেতে হচ্ছে। আবার ঢাকার বাইরে শ্রম আদালতে কোনো শ্রমিক পক্ষে রায় পেলেও মালিকপক্ষের করা আপিলের কারণে সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে নতুন করে হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে। কারণ ঢাকার বাইরে দেশের আর কোনো জেলায় আপিল ট্রাইব্যুনাল নেই।
এ বিষয়ে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, পর্যাপ্ত আদালত ও বিচারক না থাকায় শ্রমিকদের মামলাগুলো ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর। এতে শ্রমিকরা ন্যায়বিচার পাচ্ছেন না। ১১ বছরেও রানা প্লাজা ভবন ধসের তিনটি মামলার একটিরও বিচার শেষ হয়নি। শ্রমিকদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। তাদের যোগ্য মর্যাদা না দিলে শ্রম খাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি চলতেই থাকবে। শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকবান্ধব করার বিষয়েও তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ ২০২২ সালের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট শ্রমশক্তি ৭ কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৭৪ লাখ ৮ হাজার এবং নারী ২ কোটি ৫৯ লাখ ৩ হাজার। তবে ১৫ বা তদূর্ধ্ব বয়সী শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৪ কোটি ৬৯ লাখ।
বিচারে ধীরগতি
শ্রম মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত দেশের ১৩টি শ্রম আদালতে মোট ২০ হাজার ২০০টি মামলা বিচারাধীন। আর শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৮৬১টি। অথচ ২০১৭ সালের মার্চে তৎকালীন সাতটি শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ছিল ১৬ হাজার ১১৫টি মামলা। ফলে মামলার জট বাড়ছেই।
শ্রম আইনে বলা হয়েছে, দুই বা ততোধিক বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল চলবে। আইন অনুযায়ী শ্রম আদালতকে ৬০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। এ সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে উপযুক্ত কারণ ব্যাখ্যা করে আরও ৯০ দিন সময় দেওয়া যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এক যুগ আগের মামলাও আদালতে বিচারাধীন।
শ্রম আদালতগুলোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঢাকার তিনটি আদালতে যথাক্রমে ৪ হাজার ৮০২, ১ হাজার ৮৬১ ও ২ হাজার ৩৪৭, গাজীপুরে ৬ হাজার ৪৪৮, নারায়ণগঞ্জে ২ হাজার ৭৮, চট্টগ্রামের দুটি আদালতে যথাক্রমে ১ হাজার ৪৭৯ ও ৫৪৫, খুলনায় ১৪৮, কুমিল্লায় ১৪৩, রাজশাহী ৯৩, বরিশালে ৯৩, রংপুরে ৮৬ ও সিলেটে ৬৭টি মামলা বিচারাধীন। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৮৬১টির মধ্যে দুটি মামলা বর্তমানে হাইকোর্টে স্থগিত রয়েছে। এ ছাড়া ছয় মাসের ঊর্ধ্বে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ১৪ হাজার ২৮৯টি মামলা। প্রয়োজনীয় সংখ্যক আদালত, বিচারক ও সহায়ক জনবল সংকটের অভাবে বছরের পর বছর ধরে এসব মামলা ঝুলে রয়েছে।
আপিল ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান পদ শূন্য
২০২৩ সালের ২৫ এপ্রিল শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফারুকের নিয়োগ বাতিল করে সরকার। এরপর এক বছর পার হলেও চেয়ারম্যান পদ শূন্য রয়েছে। আপিল ট্রাইব্যুনালের সদস্য সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এম এ আউয়াল বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া অন্যান্য শ্রম আদালতে ২৮টি পদ শূন্য রয়েছে। এর ফলে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে মামলাজট নিষ্পত্তিও বিঘ্ন হচ্ছে।
মামলা নিষ্পত্তিতে বিকল্প পরামর্শ
শ্রম আদালতের মামলাজট কমাতে সেক্টর অনুযায়ী পৃথক কমিটি গঠনই কার্যকর বলে মনে করছেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, শ্রম আদালতে মামলা করতে গেলে শ্রমিককে নানা হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়। কারণ, পদ্ধতিটাই জটিল। তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে তাঁকে আইনজীবী নিয়োগ ও নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। এটি শ্রমিকের জন্য ব্যয়বহুলও। এ জন্য তারা আদালতে যেতে চান না।
শ্রম আইন সংশোধনের পাশাপাশি আদালতকে আরও কার্যকরের বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিদ্যমান শ্রম আইন সংশোধন পর্যায়ে রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বেসামরিক বিমান পরিবহন খাত এবং নৌপরিবহন খাতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন ও পরিচালনা সহজীকরণ, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রায়ে আপিল আবেদন সহজ করার বিধান সংযুক্ত করার কথাও বলা আছে। আশা করছি, সংশোধিত আইন কার্যকর হলে শ্রম খাত আরও সুসংহত হবে।