বঙ্গনিউজঃ নোয়াখালী-২ (সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী উপজেলার একাংশ) আসনে এবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোর্শেদ আলম। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক। এ দু’জনকে ঘিরে এ আসনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখন দু’ভাগে বিভক্ত। দুই পক্ষ পরস্পরের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ রেখেছে। বিরোধের জেরে নির্বাচনের পর এখানে ঘটেছে খুনের ঘটনা। লাশ পড়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থী মানিকের অনুসারী এক আওয়ামী লীগ কর্মীর।
আবার কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনে বর্তমান এমপি আবুল কালাম আজাদ ও সাবেক এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুলের বিরোধের জেরে নির্বাচনের পর ২০ থেকে ২৫টি গ্রামে দলীয় নেতাকর্মীর বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করা হয়েছে। মিথ্যা মামলায় হয়রানি করারও অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি এমপি আজাদকে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি।
নোয়াখালী বা কুমিল্লার এ দুই আসনের মতো চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলাতেই এমপি নির্বাচন ঘিরে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে।
বিরোধ নিরসনে আজ রোববার প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম বিভাগের ৫৫ আসনের দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিরা। এ বিভাগের ১৫ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের উপস্থিতিতে এমপিদের এমন বৈঠক এটিই প্রথম।
এ বৈঠকে চার ইস্যুতে দিকনির্দেশনা দেবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এগুলো হলো– নির্বাচন-পরবর্তী বিরোধ মেটানো, এমপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব কমানো, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি গঠন ও আসন্ন উপজেলা নির্বাচন। রাজধানীতে দলীয় কার্যালয়ে এ বৈঠকে বক্তব্য দেবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বৈঠক প্রসঙ্গে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘কী নিয়ে আলোচনা হবে, তার কোনো এজেন্ডা দেয়নি। টেলিফোনে জানানো হয়েছে। ধারণা করছি, জেলাগুলোতে সাংগঠনিক অবস্থান, দ্বন্দ্ব, নির্বাচন চলাকালে বা নির্বাচন-উত্তর দলের বিরোধ, সংঘাত– এসব নিয়ে আলোচনা হতে পারে। উপজেলা নির্বাচনের বিষয়ও থাকতে পারে।’
তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনের আগে বলা হয়েছিল, দলের হলেও স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে পারবেন নেতারা। অনেকে তাতে অংশও নিয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনের পর চলছে অপকর্ম। বাড়ছে বিরোধ, হচ্ছে মারামারি। মরছে নিজ দলের নেতাকর্মী। এ অবস্থা চলতে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দল– সম্ভবত এটি বুঝতে পেরেছে কেন্দ্র। তাই সবাইকে ডেকেছে একসঙ্গে।
নোয়াখালীতে চলছে খুনাখুনি
নোয়াখালী জেলার ৯ উপজেলায় সংসদীয় আসন ছয়টি। এর মধ্যে নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর উপজেলা), নোয়াখালী-২ (সেনবাগ ও সোনাইমুড়ী উপজেলার একাংশ) ও নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার বিপক্ষে শক্ত বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে এ তিনটি আসনেই বিজয়ী হয়েছিলেন নৌকার প্রার্থীরা। তারপরও স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করা নেতাকর্মীরা এখন আছেন চরম বিপদে। ভোটকে কেন্দ্র করে নোয়াখালী-২ আসনে বিভক্ত হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। এক পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সংসদ সদস্য মোর্শেদ আলম। অপর পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আতাউর রহমান ভূঁইয়া মানিক এবং সেনবাগ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়ন জাহাঙ্গীর আলম মানিক। নির্বাচনের পর এখানে মানিকের এক সমর্থক খুনও হয়েছেন। অভিন্ন চিত্র নোয়াখালী-৩ আসনেও। এখানে মামুনুর রশিদ কিরণের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি মিনহাজ আহম্মেদ জাবেদ। এ দুই নেতার মধ্যে এখন মুখ দেখাদেখিও বন্ধ।
বেগমগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দু’ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষের নেতৃত্বে রয়েছেন এমপি মামুনুর রশিদ কিরণ, অপর পক্ষে সাবেক সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদের ছোট ভাই মিনহাজ আহম্মেদ জাবেদ, জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ডা. এ বি এম জাফর উল্যাহ ও চৌমুহনী পৌরসভার সাবেক মেয়র আক্তার হোসেন ফয়সাল।
নোয়াখালী-৪ আসনের বর্তমান এমপি নৌকার মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন অ্যাডভোকেট শিহাব উদ্দিন শাহীন।
নোয়াখালীর সদর-সুবর্ণচর উপজেলায় আওয়ামী লীগও দু’ভাগে বিভক্ত। এখানে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সঙ্গে বিদ্রোহী প্রার্থীর দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছেছে। আগামী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, বেগমগঞ্জ, সদর ও সুবর্ণচর উপজেলায় দলীয় প্রার্থী দেওয়াকে কেন্দ্র করে আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বলে মনে করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আলম সেলিম।
কুমিল্লায় বিরোধ
কুমিল্লার ১১টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ছয়টিতে নির্বাচিত এমপিদের সঙ্গে সাবেক এমপি ও দলের উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের গ্রুপিং-কোন্দল আছে। এবারের সংসদ নির্বাচনের পর কিছু আসনে পুরোনো দ্বন্দ্ব আরও চরম আকার ধারণ করে। বর্তমানে কুমিল্লা সদর, দাউদকান্দি, চান্দিনা, দেবিদ্বার, হোমনা ও বরুড়া আসনের এমপিদের সঙ্গে সাবেক এমপি ও উপজেলার নেতাদের বিরোধ থাকায় দলের নেতাকর্মীও বিভক্ত।
কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি-তিতাস) আসনে সাবেক এমপি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়ার পরিবারের সঙ্গে বর্তমান এমপি ইঞ্জিনিয়ার আবদুস সবুরের বিরোধ রয়েছে। সুবিদ আলীর ছেলে উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সুমন এবারের সংসদ নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ না করায় সেই বিরোধ প্রকাশ্যে এসেছে।
কুমিল্লা-২ (হোমনা-মেঘনা) আসনের সাবেক এমপি সেলিমা আহমাদ মেরী এবং বর্তমান এমপি অধ্যক্ষ আবদুল মজিদের অনুসারীদের মধ্যে নির্বাচনের আগে থেকে বিরোধ চলে আসছে। গত সংসদ নির্বাচনে অধ্যক্ষ মজিদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মেরীকে পরাজিত করেন। নির্বাচনের পর সাবেক এমপি মেরী ও তাঁর অনুসারীরা সংঘাত এড়াতে কোনো দলীয় কিংবা জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন না। এমপি মেরীর অভিযোগ, ‘হোমনায় নতুন এমপির অনুসারীদের চাঁদা দেওয়া ছাড়া কোনো কাজ হয় না।’
কুমিল্লা-৪ (দেবিদ্বার) আসনের বর্তমান এমপি আবুল কালাম আজাদ ও সাবেক এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল গ্রুপের বিরোধ তীব্র হয়েছে।
কুমিল্লা-৬ (সদর) আসনের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিনের সঙ্গে সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি আঞ্জুম সুলতানা সীমার অনুসারীদের কোন্দল চলছে। সংসদ নির্বাচনে সীমা স্বতন্ত্র প্রতীকের বাহা উদ্দিনের কাছে হেরে যান। তাই এখন দলীয় কর্মসূচিও তারা পৃথকভাবে পালন করেন।
কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনতাকিম আশরাফ টিটু এবং বর্তমান এমপি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের সঙ্গে বিরোধ আছে। গত সংসদ নির্বাচনে ডা. প্রাণ গোপাল নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়ী হন। টিটু ছিলেন স্বতন্ত্র প্রতীকের প্রার্থী। আগে উপজেলা আওয়ামী লীগের অফিস টিটু অনুসারীদের দখলে থাকলেও দলীয় কার্যালয় এখন প্রাণ গোপালের অনুসারীদের দখলে।
কুমিল্লা-৮ (বরুড়া) আসনের বর্তমান এমপি এ জেড এম শফিউদ্দিন শামীম ও সাবেক এমপি নাসিমুল আলম চৌধুরী নজরুলের মধ্যে বিরোধ থাকায় উভয়ে একই মঞ্চে উঠছেন না। নজরুল বর্তমানে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ৬ আসনের ৩টিতেই কোন্দল
সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ (নাসিরনগর) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাবেক এমপি বদরুদ্দোজা মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন হেরে যান স্বতন্ত্র প্রার্থী শিল্পপতি সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামানের কাছে। পরে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তবে নাসিরনগর উপজেলা আওয়ামী লীগ এখনো তাঁকে গ্রহণ করেনি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মঈন উদ্দিন। এ নির্বাচনে মহাজোট প্রার্থী ছিলেন জাতীয় পার্টির রেজাউল ইসলাম ভূইয়া। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসের আহমেদ মঈনের পক্ষে কাজ করলেও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাজী ছফিউল্লাহ, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান হানিফ মুন্সি প্রকাশ্যেই মঈনের বিরোধিতা করেন । মঈন বিজয়ী হওয়ার পর বিভক্ত উপজেলা আওয়ামী লীগের উভয় অংশ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিলেও দূরত্ব এখনও বিরাজ করছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর) উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফয়েজুর রহমান বাদল এমপি হওয়ার পর দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেন না সাবেক এমপি বুলবুল সমর্থকরা।
কক্সবাজারে প্রকাশ্যে বিরোধ
সংসদ নির্বাচনে উখিয়া-টেকনাফ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য শাহীন আকতারের সঙ্গে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল বশর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বনি্দ্বতা করেন। এরপর থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিরোধ দেখা দিয়েছে। তবে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘জেলা কমিটিতে কোনো বিরোধ নেই। যারা দলের পদে থেকে ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলের বিরুদ্ধে কাজ করবেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রামে নতুন বিরোধ
নির্বাচন ঘিরে চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একাধিক বলয় তৈরি হয়েছে। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বন্দর পতেঙ্গা আসনে দলীয় প্রার্থী এম এ লতিফের পক্ষে কাজ করেননি। কাজ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে। তারপরও এখানে এমপি হয়েছেন লতিফ। এ নিয়ে দুই নেতার বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে।
নগরীর ডবলমুরিং-পাহাড়তলী-হালিশহর আসনে ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারীরা কাজ করেননি দলীয় প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চুর পক্ষে। তারা কাজ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনজুর আলমের পক্ষে। কিন্তু এমপি হয়েছেন মহিউদ্দিন বাচ্চু। ফলে নওফেলের অনুসারীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে এমপি বাচ্চুর।
হাটহাজারী আসনেও নির্বাচন ঘিরে দ্বিধাবিভক্ত আওয়ামী লীগ। দক্ষিণ জেলার তিনটি আসন ঘিরে বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। পটিয়া, বাঁশখালী ও সাতকানিয়ার এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনও করেছে।
শান্ত আছে পাহাড়
বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলায় আগে দলে তীব্র কোন্দল থাকলেও এখন কিছুটা কমেছে। তবে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন্দল রয়েছে। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য দীপংকর তালুকদারের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমার কোন্দল রয়েছে।