বঙ্গনিউজঃ সোমালিয়ার উপকূলে ২৩ নাবিক-ক্রুসহ জিম্মি থাকা বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’ উদ্ধারে প্রথম ধাপ পেরিয়েছে জাহাজটির মালিকপক্ষ। তারা নিশ্চিত হয়েছেন, মালিকপক্ষের সঙ্গে যারা এতদিন যোগাযোগ করেছে, তারাই ‘আসল’ জলদস্যু। জাহাজটি জিম্মি করার ৯ দিনের মাথায় গত বুধবার দস্যুরা জাহাজটির মালিকপক্ষ কেএসআরএমের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করে। তারা তখন নিজেদের ‘আসল’ জলদস্যু পরিচয় দিলেও তা নিশ্চিত হতে পারেনি মালিকপক্ষ। এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে শুক্রবার নাবিকদের সঙ্গে কথা বলতে চায় মালিকপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে নাবিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষ ও স্বজনের কথা বলার সুযোগ দেয় জলদস্যুরা। আরও আলোচনার পর মালিকপক্ষ নিশ্চিত হয়, যোগাযোগকারীরাই ‘আসল’ জলদস্যু।
এখন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে দ্বিতীয় ধাপের মূল আলোচনা শুরু করবে তারা। এখানে উভয় পক্ষ দফারফা করার পর জিম্মি ২৩ নাবিককে মুক্ত করার মূল ধাপ শুরু হবে। জাহাজটির মালিকপক্ষ বলছে, জলদস্যুরা এখনও সুনির্দিষ্টভাবে কোনো মুক্তিপণ দাবি করেনি, তবে আলোচনা চলছে। কিন্তু এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনরা বলছেন, মুক্তিপণের বিষয়টি নিশ্চয়ই স্পষ্ট করেছে জলদস্যুরা। কৌশলগত কারণে এটি গোপন রেখেছে মালিকপক্ষ।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটির মালিক কেএসআরএম গ্রুপ। ‘এমভি জাহান মণি’ নামে একই মালিকের আরেকটি জাহাজ জলদস্যুরা ছিনতাই করেছিল ১৪ বছর আগে। তখন মুক্তিপণ চেয়ে জলদস্যুদের তিনটি গ্রুপ মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে। জলদস্যুদের ‘আসল’ গ্রুপ চিহ্নিত করতে সেবার অনেক যাচাই করতে হয়েছিল মালিকপক্ষকে। তখন সময়ও ক্ষেপণ হয়েছিল অনেক বেশি। সেই জাহাজ ও জিম্মি নাবিকদের মুক্ত করতে ১০০ দিন সময় লেগেছিল মালিকপক্ষের। অতীত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার সেই কাজটি অনেক কম সময়ে সম্পন্ন করেছে তারা।
কেএসআরএমের মুখপাত্র ও গণমাধ্যম উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘এমভি জাহান মণি নামে আমাদের আরেকটি জাহাজ ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তাদের মুক্ত করতে ১০০ দিন সময় লেগেছিল। তখন জলদস্যুদের একাধিক গ্রুপ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এটি যাচাই করতে কিছুটা সময় লেগেছিল আমাদের। এবার সে অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি আমরা। তাই আরও কম সময়ে এমভি আবদুল্লাহকে মুক্ত করতে পারব বলে আশা করছি। শুক্রবার আমরা নাবিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। নাবিকরা তাদের স্বজনদের সঙ্গেও কথা বলেছেন। এসবই আলোচনার অংশ। বিস্তারিত এখন আর কিছু বলা যাবে না।’
এদিকে নাবিকদের ওপর চাপ বাড়াতে জিম্মি করে রাখা জাহাজটির চার থেকে পাঁচ নটিক্যাল মাইল দূরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করা হয়েছে। টহল দিচ্ছে সামরিক হেলিকপ্টারও। সোমালিয়ার পান্টল্যান্ডের নুগাল অঞ্চলের পুলিশ বিভাগও বাড়িয়েছে তৎপরতা। ভূমির সঙ্গে দস্যুদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চায় তারা। তবে কোনো বাহিনীকেই এখনই কমান্ডো অভিযান চালাতে দিতে রাজি নয় জাহাজটির মালিকপক্ষ। বাংলাদেশ সরকারও এ মুহূর্তে কোনো কমান্ডো অভিযান চাচ্ছে না বলে গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
ভারত মহাসাগরের নিরাপত্তায় থাকা ইউরোপীয় বাহিনী এমভি আবদুল্লাহর জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান চালানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ সরকারকে। তবে বাংলাদেশ তাতে সায় দেয়নি বলে জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব খুরশেদ আলম। সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে এ ব্যাপারে বক্তব্য দেন তিনি। এরপরও ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন অভিযান চালাতে নেয় একাধিক উদ্যোগ। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার জিম্মি জাহাজটির চার থেকে পাঁচ নটিক্যাল মাইল দূরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে। যুদ্ধজাহাজটি জিম্মি জাহাজকে নজরে রাখছে। এমভি আবদুল্লাহর চারপাশে টহল দিচ্ছে সামরিক হেলিকপ্টারও।
জানতে চাইলে নাবিকদের সংগঠন মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, ‘এ মুহূর্তে কোনো কমান্ডো অভিযান চালানো হলে নাবিকদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। বিপদ ডেকে আনতে পারে জাহাজে থাকা দাহ্য পদার্থ কয়লাও। অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়তে পারে শতকোটি টাকা মূল্যের জাহাজটি। এটি না করে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা করলে ভালো। সে পথে অনেক দূর এগিয়েছে জাহাজটির মালিকপক্ষ। কৌশলগত কারণে মুক্তিপণের বিষয়টি স্বীকার করছে না কেউ। কিন্তু আলোচনা চলছে।’ তিনি আরও জানান, সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবল থেকে এমভি রুয়েন নামে একটি বাণিজ্যিক জাহাজ উদ্ধার হয়েছে। এখন আবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের যুদ্ধজাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে নজরদারি করছে। এসব কার্যক্রম দস্যুদের ওপর চাপ তৈরি করছে। দ্রুত সমঝোতায় আসতে এসব বিষয় নেপথ্যে কাজ করবে।
জিম্মি জাহাজ ও নাবিক উদ্ধারের ক্ষেত্রে জলদস্যু, প্রি-নেগোসিয়েশন অ্যাগ্রিমেন্ট (পিএনএ) ক্লাব এবং মালিকপক্ষ মিলে দরকষাকষির মূল কাজ করে। পিএনএ ক্লাবের মধ্যস্থতায় ২০১১ সালে নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি জাহান মণি’ উদ্ধার করে। এবারও একই পথে হাঁটছে জাহাজটির মালিকপক্ষ।