বঙ্গনিউজঃ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) গত চার বছরে ছয় ঘটনায় ছাত্রলীগের ৫৮ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেন সদ্য বিদায়ী উপাচার্য শিরীণ আখতার। শিক্ষার্থীকে বিবস্ত্র করা, যৌন হয়রানি, মারামারি, চাঁদাবাজি, সাংবাদিক হেনস্তার অপরাধে তাদের বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু এক বৈঠকে বহিষ্কার করে আরেক বৈঠকে শাস্তি প্রত্যাহার করে নেন তিনি। আর প্রতি ক্ষেত্রে উল্লেখ করেন ‘মানবিক কারণ’। তাঁর এমন ‘মানবিকতা’য় বহিষ্কার হওয়া ৫৮ জনের মধ্যে ৫৬ জনকেই কোনো সাজা ভোগ করতে হয়নি।
অভিযোগ উঠেছে, ভিসি শিরীণ আখতারের এমন নমনীয়তা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে চবিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠে ছাত্রলীগ। মেয়াদের শেষ দিনে তিনি এর খেসারতও দিয়েছেন। সেদিন তাঁকে জিম্মি করে মামলা প্রত্যাহারের কাগজে সই নেন ছাত্রলীগ নেতারা। পরদিন একই অবস্থা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের। ছাত্রলীগের বাইরে কাউকে চাকরি না দিতে রেজিস্ট্রারকে হুমকি দেন চবি ছাত্রলীগ নেতারা। মামলা প্রত্যাহারের আবেদনে জোর করে রেজিস্ট্রারের সই নেন তারা।
সদ্য বিদায়ী উপাচার্য শিরীণ আখতার
বলেন, ‘শেষ দিন প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর ছাত্রলীগের শত শত নেতাকর্মী আমাকে জিম্মি করে রাখে। তারা চাকরির পাশাপাশি মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিতে থাকে। এ সময় প্রক্টর জানান, মামলা না তুলে নিলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আরও ঝামেলা করবে। তাই বাধ্য হয়ে মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশনা দিয়েছি।’
রেজিস্ট্রার কে এম নূর আহমদ বলেন, ‘নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা তো আমার নেই। তবুও জোরপূর্বক তারা সই নিয়েছে। ছাত্রলীগ ছাড়া বাকিদের নিয়োগ বাতিল করার জন্য অফিসে এসে তারা অসদাচরণ করেছে। হুমকি দিয়ে গেছে।’
চবি ছাত্রলীগ এমন বেপরোয়া হওয়ার কয়েকটি কারণ দেখেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সহসভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলা উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের লোকজন যেসব অপকর্ম করেন, তার কোনো জবাবদিহি নেই। দু-এক দিন কথা হয়, এর পর সবাই ভুলে যায়। এ কারণে ক্ষমতা থাকার সময় হোক বা শেষ দিনে হোক উপাচার্যরা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনকে খুশি রাখেন। কিংবা খুশি করতে বাধ্য হন।’ তবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী মনে করেন, নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ও চবিতে ছাত্রলীগকে বেপরোয়া করে তুলেছে।
চবিতে ছাত্রলীগ দুটি বলয়। একটি বলয় নিজেদের শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী বলে দাবি করে। অন্যটি সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী বলে পরিচয় দেয়। চবি প্রশাসনও বলে আসছে, দলের বড় নেতাদের প্রশ্রয়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে তারা কঠোর অবস্থানে যেতে পারছে না।
যেভাবে দুর্বলতা প্রকাশ করে প্রশাসন
বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব রেসিডেন্স হেলথ অ্যান্ড ডিসিপ্লিনারি কমিটি ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর রাতে এক সভায় ১২ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়। দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনায় তাদের বহিষ্কার করা হয়। দু’জনকে এক বছর করে ও অন্যদের ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করে কমিটি। ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক ওই দুই গ্রুপ হলো– ‘চুজ ফ্রেন্ডস উইদ কেয়ার’ (সিএফসি) ও ‘সিক্সটি নাইন’। সিক্সটি নাইন গ্রুপের বহিষ্কৃত নেতাকর্মীরা হলেন– ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের মো. নাঈম, একই শিক্ষাবর্ষের বাংলা বিভাগের সাইফুল ইসলাম, রসায়ন বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের আশরাফুল আলম নায়েম, একই শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের আকিব জাভেদ, ইতিহাস বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের জুনায়েদ হোসেন জয় ও অর্থনীতি বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের ফরহাদ। তাদের মধ্যে আশরাফুল আলম নায়েমকে এক বছর ও অন্যদের ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। সিএফসি গ্রুপের বহিষ্কৃতরা হলেন–আইন বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের মির্জা খবির সাদাফ, একই বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের খালেদ মাসুদ, লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের অহিদুজ্জামান সরকার, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের আরিফুল ইসলাম, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের তানজিল হোসেন ও আরবি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের তৌহিদ ইসলাম। তাদের মধ্যে মির্জা খবির সাদাফকে এক বছর ও অন্যদের ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ‘মানবিক কারণ’ দেখিয়ে প্রত্যেকের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেন উপাচার্য। একইভাবে ২০২২ সালের ২৮ জুন সাংবাদিকদের হুমকি ও অসদাচরণের জন্য ৯ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে শোকজ করা হলেও পরে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সাজা ভোগ করেছেন মাত্র দু’জন
২০২২ সালের ১৭ জুলাই রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় পাঁচ তরুণ এক ছাত্রীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করেন। ওই ঘটনায় তুমুল বিক্ষোভের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। অভিযুক্তরা এখন জামিনে রয়েছেন। তাদের দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই ছাত্রকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে কর্তৃপক্ষ। কেবল এই ঘটনাতেই বহিষ্কারাদেশ কার্যকর করে প্রশাসন। তবে বহিষ্কার হলেও ওই দুই ছাত্রলীগ কর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়ান দাপটের সঙ্গে। ছাত্রলীগের নেতাদের প্রশ্রয়ে পরিচালনা করেন দোকান। তারা হলেন– মো. আজিম ও নুরুল আবছার। আজিম হোসেন ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও সিএফসি গ্রুপের অনুসারী। আর নুরুল আবছার নৃবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও ভার্সিটি এক্সপ্রেসের কর্মী হিসেবে পরিচিত।
ছাত্রলীগ দেখলে ‘মানবিক’ হতেন উপাচার্য
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রাত ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে দুই নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করার দায়ে আরও চার ছাত্রলীগ কর্মীকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এরা হলেন– আরবি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মো. জুনায়েদ, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের রুবেল হাসান, দর্শন বিভাগের ইমন আহাম্মেদ ও আর এইচ রাজু। কিন্তু তাদের বহিষ্কারাদেশ কার্যকর করতে পারেনি প্রশাসন। তারা এখনও ক্যাম্পাসে দাপিয়ে বেড়ান। হলে রয়েছে তাদের আসন। অথচ বহিষ্কার হওয়ার পর নিয়ম অনুযায়ী কেউ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে না।
২০২৩ সালের ৯ জানুয়ারি আরেক ঘটনায় ছাত্রলীগের ১৭ নেতাকর্মীসহ ১৮ জনকে বহিষ্কার করা হয়। সংঘর্ষ, মারামারি, চাঁদাবাজি, সাংবাদিক হেনস্তাসহ বিভিন্ন ঘটনায় তাদের বহিষ্কার করা হয় ভিন্ন মেয়াদে। কিন্তু বহিষ্কারের মেয়াদ শেষ না হতেই গত বছরের ১৩ আগস্ট ‘মানবিক কারণ’ দেখিয়ে ৯ জনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে চবি প্রশাসন। বাকিদের বিষয়েও প্রশাসন নীরব। তাই ক্যাম্পাস ছাড়েনি এদের কেউই।
গুরুতর অভিযোগেও শাস্তি হয়নি
২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর শাটল ট্রেনের দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে উপাচার্যের বাসভবন, পরিবহন দপ্তর, শিক্ষক ক্লাব ও পুলিশ বক্স ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এতে ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় ৯ সেপ্টেম্বর ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার কে এম নুর আহমেদ ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা শেখ মো. আব্দুর রাজ্জাক বাদী হয়ে ২টি মামলা করেন। মামলায় ছাত্রলীগের ১২ নেতাকর্মীসহ অজ্ঞাত ১ হাজার জনকে আসামি করা হয়। এ দুই মামলায় কেউ গ্রেপ্তার হননি। শুধু তাই নয়, গত মঙ্গলবার শেষ কর্মদিবসে দুই বাদীকে মামলা দুটি প্রত্যাহারের আদেশ দেন বিদায়ী উপাচার্য।
‘স্থায়ী সমাধান’ খুঁজছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ
ক্যাম্পাসে দুপক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি চবি ছাত্রলীগের কাছে জবাব চায় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এ জন্য এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়। সংঘর্ষ ও শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ গত দুই বছরে চবি ছাত্রলীগকে শোকজ করে অন্তত তিনবার। তার পরও সংঘর্ষ ও অপকর্ম থেমে নেই। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিস্থিতি অক্ষত রাখা। কিন্তু চবিতে সাংগঠনিক দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষার পরিবেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে জিম্মি করার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে নেতাকর্মীরা। এটি নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয়। আমরা এসব বন্ধ করার জন্য স্থায়ী সমাধান খুঁজছি।’