বঙ্গনিউজঃ সময়ের হাত ধরে সমুদ্র বাণিজ্যে বইছে সুবাতাস। নীল সাগরে বাড়ছে লাল-সবুজ জাহাজের ভেঁপু। আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে চলছে বাংলাদেশেরই ৯৮ জাহাজ। আরব সাগর, লোহিত সাগর কিংবা ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এসব জাহাজ কখনও নোঙর করছে ইউরোপ, কখনও মধ্যপ্রাচ্যে। তবে চলার এই পথে এখন দেখা দিয়েছে শত বিপদ। ভারত মহাসাগরে ফাঁদ পেতে আছে সোমালিয়ার জলদস্যু। লোহিত সাগরে ওত পেতে আছে হুতি বিদ্রোহী। একের পর এক জাহাজে হামলে পড়ছে তারা। ঝুঁকিপূর্ণ এই চ্যানেল পাড়ি দিতে বিদেশিরা নিচ্ছে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তবে বাংলাদেশের জাহাজগুলো নিরাপত্তা জোরদার না করেই পাড়ি দিচ্ছে বন্ধুর পথ। তাই বাড়ছে বিপদ।
সোমালিয়ার জলদস্যু দলের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’য় ছিল না কাঁটাতারের বেষ্টনী, সশস্ত্র পাহারা। ২০১০ সালে জলদস্যুর কবলে পড়া ‘এমভি জাহান মণি’ জাহাজেরও ছিল নিরাপত্তাহীনতার অভিন্ন চিত্র। অথচ ঝুঁকিপূর্ণ এ চ্যানেল পাড়ি দিতে বাড়তি নিরাপত্তার কথা অনেক আগেই বলে রেখেছিল নৌপথ তদারককারী আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমও। বাড়তি নিরাপত্তা নিলে প্রয়োজন হয় বাড়তি কিছু খরচ। এ কারণে নিরাপত্তা কার্যক্রমের সঙ্গে আপস করে জাহাজ চালাচ্ছেন দেশীয় ১৪ গ্রুপের মালিকরা।
জাহাজ নিবন্ধনকারী সংস্থা নৌ বাণিজ্য অফিসের মুখ্য কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশের পতাকাবাহী ৯৮ জাহাজ এখন আন্তর্জাতিক সমুদ্র বাণিজ্যে নিয়োজিত। এর অনেক জাহাজই লোহিত সাগর কিংবা আরব সাগরের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পথে চলাচল করে। আইএমওর নির্দেশনা মেনে জাহাজগুলো চালাতে মালিক পক্ষকে সবসময় অনুরোধ করি আমরা। নিরাপত্তার বিষয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে নির্দেশনা আছে আইএমওর। তবে এটি বাধ্যবাধকতা পর্যায়ে না থাকায় অনেকে তা মানছেন না। তবে বাংলাদেশের পতাকাবাহী পরপর দুটি জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়ায় আমরা বাংলাদেশি জাহাজ মালিকদের ঝুঁকিপূর্ণ রুটে নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে নির্দেশ দিয়েছি।’
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আহসানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ পথে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সবার। এ ব্যাপারে জাহাজ মালিকদের বাধ্য করা উচিত আইএমওর। এখন পরিবহন খরচ কমাতে জাহাজ মালিকরা বাড়তি নিরাপত্তা আর নিচ্ছেন না। এতে ঝুঁকির মুখে পড়ছে নাবিকদের জীবন।’ তবে দ্বিমত পোষণ করে কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সব আইন মেনেই জাহাজ চালাচ্ছি আমরা। বাড়তি নিরাপত্তা নিতে আইএমও কাউকে বাধ্য করেনি। তাই এটা নিচ্ছে না কেউ কেউ। এটি নিলে খরচের বাড়তি একটা বোঝাও তৈরি হয়।’
বাংলাদেশি পতাকাবাহী সমুদ্রগামী ৯৮ জাহাজের মধ্যে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) আছে আটটি। বাকি সবই বেসরকারি খাতের। লাল-সবুজ পতাকাবাহী এসব জাহাজের পণ্য পরিবহন ক্ষমতা এখন প্রায় ৪৬ লাখ টন। সমুদ্রগামী জাহাজ মালিক সমিতির হিসাবে, বর্তমানে এ খাতে মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। ৯৮ জাহাজের মধ্যে ৭৬টি খোলা পণ্য পরিবহনকারী বাল্ক জাহাজ। এ ছাড়া তেল পরিবহনকারী ট্যাঙ্কার রয়েছে ১০টি, এলপিজি পরিবহনকারী ট্যাঙ্কার তিনটি এবং কনটেইনার পরিবহনকারী জাহাজ রয়েছে ৯টি। এসব জাহাজ সমুদ্র বাণিজ্যে নিয়োজিত থাকায় এখন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও আসছে বাংলাদেশে।
কার বহরে কত জাহাজ
সর্বোচ্চ জাহাজের মালিক হয়ে সমুদ্র বাণিজ্যে শীর্ষস্থানে আছে কেএসআরএম গ্রুপ। তাদের মালিকানাধীন জাহাজের সংখ্যা ২৩। কেএসআরএমের পণ্য পরিবহন ক্ষমতা ১১ লাখ ৭৭ হাজার টন। তবে জাহাজের সংখ্যা একটি কম থাকলেও পণ্য পরিবহনের সক্ষমতায় শীর্ষস্থানে আছে মেঘনা গ্রুপ অব কোম্পানিজ (এমজিআই)। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেই একসঙ্গে চারটি জাহাজ যুক্ত করে তারা পৌঁছে গেছে অনন্য এক উচ্চতায়। তাদের বহরে সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২টিতে। তবে তাদের পণ্য পরিবহন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ ১২ লাখ ২০ হাজার টনে। এ তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে আকিজ গ্রুপ। সমুদ্রগামী জাহাজ পরিচালনায় তারা যুক্ত হয় ২০১১ সালে। তাদের বহরে আছে ১০টি জাহাজ। এ প্রতিষ্ঠানের পণ্য পরিবহন ক্ষমতা ৫ লাখ ৬০ হাজার টন। তবে এমভি আকিজ গ্লোরি নামের সবচেয়ে বেশি পণ্য পরিবহন ক্ষমতার বাল্ক জাহাজটি আকিজ গ্রুপের হাতে। এর পণ্য পরিবহন ক্ষমতা প্রায় ৭৬ হাজার টন। পণ্য পরিবহন ক্ষমতা অনুযায়ী চতুর্থ অবস্থানে বিএসএ গ্রুপ। কর্ণফুলী লিমিটেডের এইচআর লাইনস আছে পঞ্চম অবস্থানে। এ ছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের তিনটি আলাদা প্রতিষ্ঠানের বহরে রয়েছে সাতটি জাহাজ। বড় গ্রুপগুলোর মধ্যে ওরিয়ন গ্রুপ ও এমজেএলের বহরে একটি করে জাহাজ রয়েছে। নতুন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পিএনএন শিপিং লাইনস, সানশাইন নেভিগেশন লিমিটেড, পিএইচ নেভিগেশন, দরিয়া শিপিং লিমিটেড ও ডরিন শিপিং লাইনসের জাহাজ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের আটটি জাহাজে উড়ছে লাল-সবুজ পতাকা। সব মিলিয়ে ১৪ গ্রুপের ১৭ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে ৯৮টি জাহাজ।
আয় বাড়লেও বাড়ছে না নিরাপত্তা মান
সমুদ্র পরিবহন কার্যালয় বলছে, দেশীয় জাহাজে বর্তমানে প্রায় তিন হাজার নাবিক কর্মরত। ২০২০ সালে এটি ছিল ২ হাজার ২১৩ জন। তখন নাবিকরা আয় করেছেন ৬ কোটি ৬৬ লাখ ডলার। এখন এটি ছাড়িয়েছে ৭ কোটি ডলারের ঘর। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাবিকদের যেমন আয় বেড়েছে, তেমনি মুনাফা বেড়েছে জাহাজ মালিকদেরও। তবু বাড়েনি নাবিকদের নিরাপত্তা। কোনো কোনো জাহাজে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামও থাকে না। বাইরের হামলা মোকাবিলা করার মতো সরঞ্জামেরও অভাব থাকে জাহাজে। আত্মরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় যে কোনো বিপদে সহজে আত্মসমর্পণ করতে হয় নাবিকদের। এ খাত সম্প্রসারণে সরকার নানা সুযোগ দিলেও মালিকরা জোরদার করছে না নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঝুঁকিপূর্ণ চ্যানেল পাড়ি দেওয়ার সময় তারা কোনো বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নিচ্ছে না গানম্যান। দিচ্ছে না কাঁটাতারের বেষ্টনী। অথচ এসব ব্যবস্থা থাকলে জলদস্যুদের মতো কেউ চাইলেই উঠতে পারবে না জাহাজে।
যেভাবে বিপদে পড়ে জাহাজ
জাহাজের সাবেক ক্যাপ্টেন ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী জানান, জাহাজে পণ্যবোঝাই থাকায় আন্তর্জাতিক নৌপথে জাহাজগুলো সাধারণত ধীরে চলে। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজে ৫৫ হাজার টন পণ্য থাকলেও সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ হাজার টন পণ্যবোঝাই থাকে এসব জাহাজে। বেশি পণ্যবোঝাই থাকায় বেশির ভাগ জাহাজের গতি থাকে ১৮ থেকে ২০ নটিক্যাল মাইল। এ কারণে জলদস্যুরা ছোট ছোট বোটে অস্ত্র নিয়ে তিন থেকে চারদিক থেকে আক্রমণ করতে পারে সহজে। একসঙ্গে কয়েক দিক থেকে হামলা হলে তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে জলদস্যুরা। তবে আত্মরক্ষার জন্য জাহাজে নাবিকদের কাছে ভারী কোনো সরঞ্জাম থাকে না। বিশেষভাবে নিযুক্ত গানম্যান না থাকলে তখন আর পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে না কেউ।
সাগরের বাঁকে বাঁকে বিপদ
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন বলেন, গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধ ও হুতি বিদ্রোহীদের আক্রমণের কারণে লোহিত সাগর এখন হটস্পট। সবার মনোযোগ ওদিকে। এটিকে বাড়তি সুযোগ হিসেবে নিয়েছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। তারা কার্যক্রম জোরদার করেছে ভারত মহাসাগরে। যে স্থান থেকে এমভি আবদুল্লাহকে তারা ছিনতাই করেছে, সেটা মহাসাগরের অনেক গভীরে। এখানে তাদের আসার কথা নয়। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় তারা উপকূল থেকে প্রায় ৫০০ নটিক্যাল মাইল দূরে এসে এমভি আবদুল্লাহর ওপর হামলা করেছে। এই জাহাজের নিরাপত্তা দুর্বলতা সম্পর্কেও আগে থেকে কোনো ধারণা থাকতে পারে তাদের।
তিনি বলেন, শুরুর দিকে হুতিরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পৃক্ত জাহাজ লক্ষ্য করেই শুধু হামলা করেছে। জানুয়ারি থেকে তাদের হামলার শিকার বেশির ভাগ জাহাজই ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মালিকানাধীন বা তাদের পরিচালনাধীন। নভেম্বরে আক্রমণ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ২৮টি জাহাজে হামলার ঘটনা ঘটেছে লোহিত সাগরে। অথচ এটি পণ্য পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ একটি রুট। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে পণ্য পরিবহনের সবচেয়ে কার্যকর পথ হচ্ছে লোহিত সাগর ও আরব সাগর।
কেন ঝুঁকি নেন জাহাজ মালিকরা
জাহাজ ট্র্যাকিং ফার্ম লয়েডস লিস্ট ইন্টেলিজেন্সের মতে, হুতি হামলা শুরুর পর লোহিত সাগর ব্যবহার করা বাণিজ্যিক জাহাজের সংখ্যা ৫০ শতাংশ কমে গেছে। তবে একেবারে বন্ধ হয়নি। জাহাজ মালিকদের কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়েই পণ্য পরিবহন করছেন এই পথে। কারণ আফ্রিকার বিকল্প পথ ব্যবহার করলে জ্বালানি খরচ বেশি পড়ে। সেই সঙ্গে ক্রুদের মজুরি দিতে হয় বেশি। বাড়তি গুনতে হয় বীমা খরচও। যেমন– সাংহাই থেকে রটারডাম পর্যন্ত একটি স্বাভাবিক আকারের ৪০ ফুট কনটেইনার পরিবহনের খরচ নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ছিল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ডলার। তবে জানুয়ারির শেষে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ৫ হাজার ডলার। আবার গানম্যানসহ বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিতে গেলে প্রত্যেক জাহাজ মালিককে প্রায় এক মিলিয়ন ডলার বাড়তি গুনতে হয়। এ জন্য জাহাজগুলো বাড়তি নিরাপত্তা ছাড়াই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে লোহিত সাগর কিংবা আরব সাগরে।