এখনও ঢেঁকি ছাঁটা চালের চাহিদা বেশি। কারন এটা অনেক পুষ্ঠিকর। খেতে সুস্বাদু হয়। চালের কুঁড়া চালের সাথে সংযুক্ত থাকে বলে এসব সুবিধা পাওয়া যায়। কিন্তু পুরাতন ঐতিহ্যের এই সনাতনী ঢেঁকি এখন আর দেখা যাবে না কোথাও। শুধু মাত্র জাদু ঘরে হয়তোবা দেখা মিলতে পারে। চালের মধ্যে আজকাল অসাধু ব্যবসায়িগন অনেক ভেজাল দিয়ে অথবা কৃত্রিম উপায়ে মেটা,সরু বা বিভিন্ন রংয়ের চাল তৈরি করে মানুষকে প্রতারিত করতেও শুনা যায়।
ট্রাকের নিচে ফুয়েল ট্যাংকারের গায়ে খুব সুন্দর ক্যালিগ্রাফিক স্টাইলে দেখেছি লেখা থাকে, “ জন্ম থেকে জ্বলছি “ । বুঝতে পারলাম কি এক অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সে জন্ম থেকে জ্বলে পুড়ে চলেছে। কিন্তু ঢেঁকির তেমন কোন অনুভুতির কথা কোথাও থেকে জানা যায় না। ঢেঁকি যদি ভাবে যে, আমি জন্ম থেকে শুধু লাথি খেয়ে চলেছি, তাতেও আর্শ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কারণ জন্মের পর থেকেই তার ভাগ্যে এটি জোটে থাকে। লাথি না দিলে সে অচল। যদিও অনেকে বলেন যে, “ ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও বাড়া ভানে” । সে কি তাতে তৃপ্ত নাকি অতৃপ্ত ? এমন একটা প্রশ্ন জাগে। তবে যেহেতু কোনদিন ঢেঁকিকে বিট্রে করতে দেখা যায় না, এবং ফুয়েল ট্যাংকারের মতো প্রতিক্রীয়া কোথাও লক্ষ্য করা যায়নি, তাই মনে হয় সে খুব তৃপ্ত। এরও কারণ হয়তো একটাই, চরণ স্পর্শ পাওয়ার তৃপ্তি। তাও আবার রমণীকুলের চরণ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, কাজি নজরুল সহ অনেক কবি সাহিত্যিক চরণ পাবার প্রার্থনা করেছেন। কবিগুরু বলেছেন- “ চরণ ধরিতে দিও গো আমারে, নিয়ো না নিয়ো না সরায়ে। বলেছেন, তোমার চরণে দেব হৃদয় খুলিয়া। বলেছেন, “ চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি, গোপনে তোমারে সখা কত ভালোবাসি। কাজি নজরুল কীর্তন অঙ্গের গানে লিখেছেন, “ হে গোবিন্দ রাখো চরণে”। তব চরণে শরনাগত। বলেছেন, “চলে গেলো হরি, তোরা পায়ে ধরি, কেন নাহি ফিরাইলি, সখি আমি না হয় মান করেছিনু তোরা তো সকলে ছিলি”। আবার নজরুলের ইসলামী গজলে বা সঙ্গীতেও এ ধরণের লেখা আছে। রাধাকৃষ্ণের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কে বড় এমন বিতর্ক নিয়ে শুক-সারির দ্বন্দ নামে একটা কীর্তন আছে। সেখানে তর্কের মধ্যে আছে- “ শুক বলে আমার কৃষ্ণের চূড়া বামে হেলে। তখন সারি উত্তরে বলে “সেতো আমার রাধার চরণ পাবে বলে “। আবার গ্রাম্য পালা গানেও বন্দনা গাইতে গিয়ে কবিয়ালগন বলেন , “ আসরে আছেন যত জ্ঞানী-গুণীজন, সকলের চরণ আমি করিলাম বন্দন। লোকগীতিতে আছে- “ আগে যদি জানতাম রে বন্ধু, যাইবারে ছাড়িয়া, দুই চরণ বান্ধিয়া রাখতাম মাথার কেশ দিয়া “। যা হোক , এসব থেকে আমার ধারণা চরণ পাবার তৃপ্তিতেই বোধ হয় ঢেঁকি পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত । তবে ঢেঁকি স্বর্গে গেলে বাড়া ভানে কিনা তাও কোন শাস্ত্রে উল্লেখ পাইনি। মানুষ স্বর্গে গেলে সুন্দরী অপ্সরী পায়। তাদের নৃত্য উপভোগ করা যায়। স্বর্গী য় সব সুমিষ্ট ফলাদি খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে। আছে অমিয় সুধা পানের ব্যবস্থা। আর নরকে গেলে পার হতে হবে উত্তপ্ত রক্তের নদী বৈতরনী। সইতে হবে যমরাজের কঠিন অত্যাচার। সইতে হবে গদার আঘাত। নিক্ষেপ করা হবে কঠিনতম জ্বলন্ত অগ্নি কুন্ডে। কিন্তু ঢেঁকি স্বর্গে গেলে কি করে তার কোন শাস্ত্রীয় প্রমান পোওয়া যায় না। শুধু লোক মুখে শোনা।
স্কুল জীবনে বহু আত্মকাহিনী মুখস্থ করে ছিলাম। একটি নদীর আত্মকাহিনী, একটি চোরের আত্মকাহিনী, একটি বটগাছের আত্মকাহিনী, একটি চেয়ারের আত্মকাহিনি আরও কত কি। পড়তে পড়তে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি। নদীটি বলছে- আমার নাম সুরমা। তাই বলে আমি চোখে দিবার সুরমা নই। আমি একটি নদী। সিলেটের এক কোনে আমার বাস। আবার বটগাছ বলছে- আমি পথের ধারে থেকে পথিকদেরকে ছায়া দান করি। আমার ফল পাখিদের খাদ্য। আমার ছায়ায় ক্লান্ত পথিক ঘুমিয়ে বিশ্রাম নেয়। একবার কয়েকটি চোর রাতে এসে আমার নিচে বসে চুরি করা মালামাল ভাগ বন্টন করা কালে এক চৌকিদার তাড়া করে। আবার চোর তার আত্মকাহিনীতে বলে, আমি একজন চোর। শিশুদের মুখে কটি ক্ষুধার অন্ন তুলে দিতে রাতে চুরি করি। এ ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। একদিন গৃহস্থরা আমাকে ধরে ফেলে। আমাকে বেঁধে নিয়ে এসে এতোটাই মারধর করেছে যে, আমি কাঁদদেও ভুলে গিয়ে ছিলাম। গা বেয়ে রক্ত ঝড়ছে। যখন যে আসছে, সেই লাঠি হাতে নিয়ে বেদম প্রহার করছে। যেন মারের এক প্রতিযোগীতা চলছে। এমন সময় একটি শিশু প্রচন্ড ভীড় ঠেলে এলো চোর দেখবে বলে। কেহই তাকে নিবৃত করতে পাছিল না। সে আমাকে দেখেই জোরে জোরে বলতে লাগলো- “ এতো মানুষ, চোর নয়, তোমরা মিথ্যে বলছো। “। প্রচন্ড আঘাতেও আমার চোখে জল আসেনি। কিন্তু শিশুটির এই কথায় আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আত্মকাহিনী পড়তে পড়তে আমিও মনের অজান্তে বলে ছিলাম, আহা! বেচারা !!
যাহোক , ঢেঁকির অন্তত একটা আত্মকাহিনী পড়তে পারলে হয়তো জানতে সুবিধা হতো, ঢেঁকি কি জন্ম থেকে লাথি খেয়ে খেয়ে কষ্টে আছে কিনা ? নাকি চরণ পাবার আনন্দে পরিতৃপ্ত।