গায়ে হলুদ ও ঢেঁকি সমাচার-পর্ব-৩:- স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » গায়ে হলুদ ও ঢেঁকি সমাচার-পর্ব-৩:- স্বপন চক্রবর্তী
মঙ্গলবার ● ১২ মার্চ ২০২৪


ঢেঁকিতে হলুদ কোটা হচ্ছে
উপরোক্ত লেখাগুলো প্রাসঙ্গিক ভাবে লিখতে হয়েছে। আমার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল বিলুপ্তপ্রায় ঢেঁকি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা। একসময় প্রতিটি বাড়িতে না হলেও দুএক বাড়ি পরপর ঢেঁকি থাকতো, ঢেঁকি ঘর থাকতো। যারা বয়সের দিক থেকে অন্তত চল্লিশ অতিক্রম করেছেন তারা সবাই এ জিনিষটা ভালো করেই দেখেছেন এবং এর সাথে পরিচিত আছেন। এক সময়ে নিত্যদিনের একটা অনুসঙ্গ ছিল ঢেঁকি। কিন্তু নতুন প্রজন্মের যারা তারা এটা অনেকেই হয়তো চিনবেন না। তাদেরকে এটা দেখাতে হলে জাদুঘরে নিয়ে যেতে হবে। ঢেঁকির ব্যবহার এবং এর বিভিন্ন অংশের নাম ও তৈরী করার পদ্ধতি তাদের অনেকেরই অজানা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বিলুপ্তপ্রায় এই ঢেঁকি নিয়ে দুএকটি কথা-
ঢেঁকির ব্যবহার ঠিক কখন কোথায় শুরু হয়েছিল সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও আবহমান কাল থেকেই ঢেঁকি বাঙালির খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত ছিল। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে একসময়ে ঢেঁকিও একটা সহায়ক উপকরণ হিসাবে আবির্ভুত হলো। কৃষি উপকরণের মতোই জীবন চলার পথে অপরিহার্য ছিল এই ঢেঁকি।
একসময় ঢেঁকি নিয়ে কতকথা শুনা যেতো। যেমন বাগ্বিধি পড়েছি। “আমড়া কাঠের ঢেঁকি” । এটা অপদার্থকে বুঝাতে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু বাস্তবে ভালো কাঠের ঢেঁকি ছিল খুব উপকরিী। আবার মনস্তাপ হিসাবে বলা হতো “ ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও বাড়া ভানে” । মানে সে যেখানেই যাকনা কেন, তার ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। আবার বহু গান গীত হতো একসময় এই ঢেঁকিকে নিয়ে। যেমন “ ও ধান ভানি রে, ঢেঁকিতে পার দিয়া, ঢেঁকি নাচে আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া”। আবার গ্রাম্য রস ও রসিকতার সময়ও ঢেঁকির কথাই উপমা হিসাবে ব্যবহৃত হতো। গ্রাম্য কবি গানেও এমনটি শুনা যেতো। যেমন শীতের রাতের একজন ভদ্রলোকের শোয়ার বর্ণনা দিতে গিযে বলতো যে, “ প্রথম প্রহরে বাবু ঢেঁকি অবতার, দ্বিতীয় প্রহরে বাবু ধনুতে টংকার, তৃতীয় প্রহরে বাবু কুকুর কুন্ডলী, চতুর্থ প্রহরে বাবু বানিয়ার পুটুলী। এসব থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, জীবন চলার পথে কতটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল ঢেঁকি। ঢেঁকি ছিল জীবন চলার পথের অন্যতম আর একটি অনুসঙ্গ।
ঢেঁকির ক্যাঁত ক্যাঁত শব্দ হতো তার খুঁটিতে। কিন্তু ধ্বপ ধ্বপ আওয়াজ হতো লোটের উপর যখন চুরুনের প্রচন্ড আঘাত পড়তো ঢেঁকি পার দিয়ে চালানোর সময়। সে শব্দ গ্রামের শেষ মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যেতো। গ্রামের মানুষ টের পেতো যে কোন বাড়িতে ধান ভানার কাজ চলছে।
নবান্নের ধান ঘরে আসার পর প্রতিটি ঘরে আনন্দের বন্যা বইয়ে যেতো। তখনই ঢেঁকিঘরও সতেজ হয়ে যেতো। ধোয়ে মুছে পরিষ্কার করা হতো ঢেঁকিশালকে। টিনের বা খড়ের ঘরে স্থাপিত হতো ঢেঁকি। ৫/৬ ফুটের একটি শক্ত কাঠের খন্ড দিয়ে কাঠমিস্ত্রির সাহায্যে সুন্দর করে ঢেঁকি তৈরী করা হতো এটিকে। অনেক ঢেঁকিতে মিস্ত্রীগন নক্সা এঁকে এটিকে বেশ সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন করতেন। নবান্নের আগমনে প্রতিটি গৃহস্থ পরিবারে উৎসব লেগে যেতো। তাতে এই ঢেঁকির কদর বেড়ে যেতো। খাবার জন্য চাল তৈরী হতো ঢেঁকিতে। চাল  থেকে আবার  মুড়ি-মুড়কি তৈরী হতো। খেজুরের গুড় অথবা আখের গুড় দিয়ে চালের থেকে তৈরী মুড়িকে পাক দিয়ে মুড়কি বানানো হতো। নিজ গৃহে ঢেঁকিতে পার দিয়ে ধান থেকে চিড়াও তৈরি করা হতো। চিড়া থেকে আবার চিড়া ও গুড়ের সংমিশ্রণে তৈরি হতো চিড়ার মোয়া। সেই মুড়ি-মুড়কি বা মোয়া ছিল সকলের জন্য সকালের জলপানের উপকরণ। অতিথি আপ্যায়নও হতো তাই দিয়ে। সে সব গ্রাম্য আপ্যায়নে থাকতো হৃদয়ের ছোঁয়া, থাকতো আন্তরিকতা। কোন পথিক এসে যদি খাবার জল চাইতো, তখন কোন অবস্থাতেই শুধুমাত্র জল দেওয়া হতো না। এটাকে গৃহস্থের জন্য অমঙ্গল জনক মনে করা হতো। তাই কাঁসার থালাকে ট্রে স্বরূপ ব্যবহার করে, ফটিকের ( কাঁচের ) বা কাঁসার গ্লাসে এক গ্লাস জলের সাথে চিড়া, মুড়ি মুড়কী বা নিদেন পক্ষে দুটো বাতাসা সহযোগে তৃষ্ণার্থকে আপ্যায়িত করা হতো। অনেকের ঘরে থাকতো দুধের তৈরি লাড়ু,সন্দেশ ইত্যাদি । এসব দিয়েই তুষ্ট করার চেষ্টা হতো পান্থ পথিককে। এই জলপান নিয়ে অনেক গল্প,নাটক বা পালাও রচিত হয়েছে। গীত হতো “জল খাইতে গিয়া ছিলাম দিন ভিখারির বাড়ি, কে যেন জল আইনা দিলো, মানুষ কিংবা পরি গো”। অর্থাৎ শুধু জল খেতে গিয়েই নারীর প্রেমে মজে গেলো অচেনা কোন পথিক।
যাহোক , মানুষের জীবন থেকেই যেহেতু নাটকের শুরু, তাই এসবকে শুধু মাত্র গান, নাটক বা অমূলক সাহিত্যসৃষ্টি বলা যায় না। যদিও এখন কেহ আর জল পান করতে যায় না। সে সংস্কৃতিও আর নেই। জল খেতে গিয়ে প্রেমে পড়ার কথা এখন তেমন আর নেই। তৃষ্ণার্থ পথিকগন আগেই এক বোতল জল কিনে সাথে রাখতে ভুলে যান না। তবে আপ্যায়নের সে স্থানটি এখন দখল করে নিয়েছে নুডুলস, সেমাই, চপ, পেটিস বা চা-বিস্কুট। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমার একদা সবচেয়ে অপছন্দের খাবার ছিল নুডুলস আর ব্যাঙ্গের ছাতার মতো দেখতে মাশরুম। এর কারন আর উল্লেখ করতে চাই না। তবে এখন সব সহ্য হয়ে গেছে। মুড়ি-মুড়কি চিড়া ইত্যাদির অভ্যাসও ভুলে গেছি। তাই হয়তো বলা হয় যে, মানুষ অভ্যাসের অধীন। ( চলবে )

বাংলাদেশ সময়: ১৭:২৩:৩৪ ● ৫৬০ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ