কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতির

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতির
মঙ্গলবার ● ১২ মার্চ ২০২৪


কিছুতেই লাগাম টানা যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতির

বঙ্গনিউজঃ   মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নিলেও তাতে কাজ হচ্ছে না। মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে প্রতি মাসেই সুদহার বাড়ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে ব্যবসার খরচ। বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সুদহার বৃদ্ধি অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি করছে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করছেন।
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি রয়েছে। গত ডিসেম্বরে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। চলতি রমজান মাসকে কেন্দ্র করে বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বেড়েছে। ফলে মার্চে মূল্যস্ফীতি আগের চেয়ে বাড়বে বলে ধারণা করা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। এর সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ চেইনসহ অন্যান্য অনেক বিষয় জড়িত।

সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থনীতির প্রচলিত নিয়মে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানো যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও গত জুলাই থেকে মুদ্রানীতি সংকোচনের মাধ্যমে বাজারে তারল্য কমাচ্ছে। সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ সরবরাহ না করে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিতে বলা হয়েছে। আবার ডলার বিক্রির বিপরীতে বাজার থেকে টাকা উঠে এসেছে। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই সুদহার দ্রুত বাড়ছে। ঋণের পাশাপাশি আমানতের সুদ বাড়লে মানুষ ভোগ কমিয়ে সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ হয়। আবার ঋণ নিয়ে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কম দেখায়। এতে উৎপাদনও কম হয়। একই সঙ্গে ভোগের জন্য ঋণ নেওয়ার আগ্রহ কমে। তবে আমাদের এখানে অনেক ক্ষেত্রে অর্থনীতির সাধারণ এ নিয়ম অনেক সময় কাজে আসে না। আমদানিনির্ভরতার কারণে ‘কস্ট পুশ’ তথা ডলারের দরজনিত একটি মূল্যস্ফীতি হয়। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা অনেক ক্ষেত্রে যে কোনো একটি অজুহাত সামনে এনে কারণ ছাড়াই দর বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য একটি ভালো খবর হলো, ডলারের দর অনেক দিন ধরে তেমন বাড়ছে না। আমদানিতে ১২২ থেকে ১২৪ টাকায় স্থিতিশীল হয়ে আছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের স্মার্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতি মাসে সুদহার বাড়ানো হচ্ছে। এভাবে সুদহার বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার খরচ বাড়ছে। আগামী জুনের মধ্যে যেন নতুন করে আর সুদহার না বাড়ানো হয়, সে দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, ডলার বাজারে কিছুটা স্থিতিশীলতা ফিরছে। ডলারের দর যদি কমে আসে, বাজার স্বাভাবিক হবে।

রোববার ঢাকা চেম্বার আয়োজিত এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় কয়েকজন ব্যবসায়ী নেতা বলেন, এভাবে সুদহার বাড়লে কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ আসবে না। নতুন কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হবে। শুধু বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের ফর্মুলায় দেশ চলবে না।

যদিও একই বৈঠকে উপস্থিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কোনো বিকল্প নেই। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্যই অনেক দেশের তুলনায় কম আগ্রাসীভাবে সুদ বাড়ানো হয়েছে। স্মার্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে সুদহার না বাড়ালে একবারে আরও অনেক বেড়ে ব্যবসার ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি করত। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এর আগে বিভিন্ন সময় মূল্যস্ফীতি কমাতে অর্থনীতিবহির্ভূত বিষয় তথা বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন  বলেন, সুদহার বাড়ালে এর প্রভাব পড়তে ৬ থেকে ৯ মাস, কখনও-কখনও এক বছর সময় লাগে। তবে আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতির পেছনে শুধু সুদহারের প্রভাব আছে তেমন নয়। অনেক সময় সরবরাহকারীদের সিন্ডিকেটের কারণে পণ্যমূল্য বাড়ে। তিনি বলেন, রমজান উপলক্ষে অনেক দেশে পণ্যমূল্য কমে অর্ধেকে নেমেছে। আর আমাদের এখানে দর বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এখন এই দর বৃদ্ধি তো আর সুদহার দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থনৈতিক ও অর্থনীতি-বহির্ভূত দুটি বিষয় একসঙ্গে কাজ করতে হবে। মুদ্রানীতি সংকোচন ও ডলারের দর স্থিতিশীল রাখার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনৈতিক বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করছে। এরই মধ্যে বাজারে তারল্য সরবরাহ কমেছে। একই সঙ্গে অর্থনীতি-বহির্ভূত বিষয় তথা সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত করা, পরিবহন খরচ, ইউটিলিটি চার্জ, চাঁদাবাজির মতো বিষয় দেখার দায়িত্ব সরকারের। এ দুয়ের সমন্বয় না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে না।

প্রতি মাসেই বাড়তি সুদ গুনতে হচ্ছে
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা নির্ধারিত ছিল। তবে আইএমএফের ঋণের শর্ত এবং বাজারে তারল্য সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য গত জুলাই থেকে সুদহারের নতুন ব্যবস্থা চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ব্যবস্থাকে বলা হচ্ছে স্মার্ট তথা সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল। ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদহারের ভিত্তিতে এ সুদ নির্ধারণ করা হচ্ছে। স্মার্টের সঙ্গে বর্তমানে সাড়ে ৩ শতাংশ মার্জিন যোগ করে সুদ নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলো। গত ফেব্রুয়ারি মাসের স্মার্ট ছিল ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ। এর মানে মার্চে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদ উঠেছে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। সিএমএসএমই, ব্যক্তিগত এবং গাড়ি কেনার ঋণের অতিরিক্ত ১ শতাংশ তদারকি চার্জ আরোপ করতে পারে ব্যাংক। এর মানে এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার উঠেছে ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ। নতুন ব্যবস্থা চালুর পর গত জুলাই মাসে ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার উঠেছিল ৯ দশমিক ১০ শতাংশ। এর পর প্রতি মাসে বেড়ে এ পর্যায়ে এসেছে। প্রতি মাসে সুদহার বৃদ্ধির ফলে বিদ্যমান ঋণেও প্রতি মাসে সুদহার বাড়ছে, তেমন নয়। বরং ছয় মাস অন্তর ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়াতে পারবে। এ ক্ষেত্রে একজন গ্রাহকের হয়তো গত জানুয়ারিতে ব্যাংক সুদহার বাড়িয়েছে। এখন আগামী জুলাই মাসের আগে আর তাঁর সুদ বাড়াতে পারবে না।

রিজার্ভ আবার ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে
ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খুলে অর্থ জমা, অফশোর ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন নীতি শিথিলতা করা হয়েছে। আবার কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে ডলার আনা হয়েছে। এতে করে ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নামা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত সপ্তাহে বেড়ে ২১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। গত সপ্তাহ শেষে রিজার্ভ দাঁড়ায় ২১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। তবে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) ১২৯ কোটি ডলার পরিশোধের পর তা আবার ২০ বিলিয়নের নিচে নেমেছে। গতকাল রিজার্ভ দাঁড়ায় ১৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার। যদিও ডলার নিয়ে হাহাকার কিছুটা কমেছে। মূলত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ব্যাংকিং চ্যানেলে ৪২৮ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৭৬ কোটি ডলার বা ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। আবার গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রথম আট মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৫ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি। আবার বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে আমদানি কমিয়ে রাখা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ১৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ। গত অর্থবছর আমদানি কমেছিল ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। এসব কারণে রিজার্ভ বাড়া-কমার মধ্যে থাকলেও ডলার বাজার স্থিতিশীল হয়ে আছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০:৪৫:১২ ● ১৩৭ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ