একমাত্র যানবাহন নৌকা ২৪ হাজার মানুষের চলাচলের

Home Page » সংবাদ শিরোনাম » একমাত্র যানবাহন নৌকা ২৪ হাজার মানুষের চলাচলের
বৃহস্পতিবার ● ৭ মার্চ ২০২৪


কুমারখালীর চরসাদিপুরের মানুষের চলাচলের একমাত্র যানবাহন নৌকা।

বঙ্গনিউজঃ    বড় বড় অফিসারদের মুখ দেখিনি কোনোদিন। ছোটরাও ঠিকঠাক আসেন না। হাসপাতাল, পরিষদ, স্কুল কখন খোলে কখন বন্ধ করে কিছু বুঝাও যায় না। হাসপাতালে রোগী গেলে ডাক্তার থাকে না, ওষুধ থাকে না। শুনি সরকার কতকিছু বরাদ্দ দেয়, কিছুই চরোরা পাই না। সব থাকে যায় নদীর ওপারে। কোনো সেবায় পার হয় না নদী। জনগণের ভোগান্তির শেষ নাই।’

আক্ষেপ করে আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলছিলেন কুমারখালীর চরসাদিপুর ইউনিয়নের সাদিপুর বাজারের পল্লী চিকিৎসক মো. শহিদুল আলম (৭০)। তার দাবি, পদ্মানদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ, নয়তো ফেরি চালু অথবা সীমানা ভাগাভাগি করে পার্শ্ববর্তী পাবনা জেলার সাথে সংযুক্ত করা হোক ।

পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে ( উত্তর) প্রায় ২৫ বর্গমাইল আয়তন নিয়ে গঠিত চরসাদীপুর ইউনিয়ন। সেখানে ৯ টি গ্রামে প্রায় ২৪ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের জন্য রয়েছে একটি ইউপি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ছয়টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চারটি মাদ্রাসা, একটি এতিমখানা ও চারটি বেসরকারি কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ইউনিয়নটি উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার এবং জেলা শহর থেকে প্রায় ২৯ কিলোমিটার দুরে। পদ্মা নদীর বুকে নৌকা তাদের একমাত্র যাতায়াতের যানবাহন। এর উত্তর ও পশ্চিমে রয়েছে পার্শ্ববর্তী পাবনা জেলার হেমায়েতপুর ও সদর উপজেলার দৌগাছি ইউনিয়ন।

জানা গেছে, প্রায় ৬ কিলোমিটার পদ্মা নদীর বুকের ওপর দিয়ে জেলা ও উপজেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন চর সাদিপুরের বাসিন্দারা। বর্ষা মৌসুমে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ইঞ্জিনচালিত ডিঙি নৌকা। আর শুষ্ক মৌসুমে নদীর অধিকাংশ জুড়ে চর জাগে। তখন পানিতে নৌকা ও চরে ইজিবাইক, বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন তারা। এতে একদিকে যেমন অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয় তাঁদের, অন্যদিকে চরম ভোগান্তির পাশাপাশি খোয়াতে হয় প্রচুর সময়।

আরো জানা গেছে, উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় চরম অবহেলিত চর সাদিপুরের মানুষ। প্রশাসনের নজরদারির অভাবে দিনেদিনে সেখানে বাড়ছে মাদক, বাল্যবিবাহ, চুরি, ডাকাতিসহ নানান অপরাধমূলক কাজ। গড়ে উঠেছে প্রায় ৪০ টি ইটভাটা। যার সবগুলোই অবৈধ। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে ইউনিয়নে চলাচলের একমাত্র পাকা সড়কটিও খানাখন্দে ভরা।

লেনদেন ও সঞ্চয়ের জন্য অন্যান্য ইউনিয়নে সরকারি-বেসরকারি একাধিক ব্যাংক থাকলেও চরসাদিপুরে নেই একটিও। সেখানে নেই পোস্ট অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে পদ থাকলেও নেই গর্ভবতী মহিলাদের চিকিৎসক। নেই পুলিশ ক্যাম্প। এসবসহ নানাবিধ কারণে বছরের পর বছর চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ।

বাসিন্দাদের দাবি, পদ্মানদীর ওপরে একটি সেতু নির্মাণ বা নদীতে ফেরি চালু করা হলে তাদের জীবনমান উন্নত ও সহজতর হতো। অথবা পাবনা জেলার সাথে তাদের সংযুক্ত করা হলেও কমতো ভোগান্তি।

বৃহস্পতিবার (২৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রমত্ত পদ্মা নদীর অধিকাংশ স্থানে চর জেগেছে। মানুষ প্রথমে একটি নৌকায় প্রায় দেড় কিলোমিটার নদী পার হচ্ছে। আবার প্রায় আড়াই কিলোমিটার চরে কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ ইজিবাইক, কেউবা মোটরসাইকেলে চড়ে পার হয়ে আরেকটি নৌকায় উঠছে। এরপর আরো আধা কিলোমিটার নদী নৌকায় পার হয়ে পুনরায় হেঁটে, ইজিবাইক ও মোটরসাইকেলে করে প্রধান সড়কে উঠে চলাচল করছে।

এসময় পথচারী আব্দুল হামিদ জানান, তিনি পাবনা সদরে দিনমজুরের কাজ করেন। তিনি প্রথমে খেয়াঘাটে ৪০ টাকা দিয়ে নৌকায় উঠেছেন। নৌকা থেকে নেমে ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে ইজিবাইকে চড়েছেন। ইজিবাইক থেকে নেমে আরো একটি নৌকায় ওঠেন। সেখান থেকে নেমে আরো ২০ টাকা দিয়ে ইজিবাইকে নদী পার হয়েছেন। তার ভাষ্যমতে, প্রায় ৪০ থেকে ৫০ মিনিট লাগে নদী পার হতে। এতে মানুষের চরম ভোগান্তি হয়। প্রচুর অর্থ, শ্রম ও সময় ব্যয় হয়।

মাঝি আলাই শেখ জানান, তিনি প্রায় ৩০-৩৫ বছর যাবৎ নৌকা চালাচ্ছেন। বর্ষায় শুধু নৌকা এবং শুষ্ক মৌসুমে নৌকা ও বিভিন্ন যানবাহনে চড়ে মানুষ প্রায় ৬ কিলোমিটার নদী পার হয়ে চলাচল করে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ফসলের মাঠে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ইটভাটা। ভাটায় আইন ভেঙে পুড়ছে কাঠ। কৃষিজমি ও নদীকূল থেকে কাটা হচ্ছে মাটি ও বালু। ইউনিয়নে যোগাযোগের একমাত্র পাকা সড়কটিও খানাখন্দে ভরা ও জরাজীর্ণ। চলছে শ্যালো ইঞ্জিন চালিত অবৈধ লাটাহাম্বা গাড়ি। ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে মানুষ।

এসময় বয়োজ্যেষ্ঠ কৃষক ফয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস (৭৫) আক্ষেপ করে বলেন, ‘এক নদীর জন্য আমাদের কপাল পুড়েছে। নদীর অজুহাতে অফিসাররা খোঁজ নেয় না। সরকার ফ্রি ফ্রি সার, বীজ আরো কত কী দেয়। চাষাবাদের বিভিন্ন যন্ত্র দেয়। কিন্তু আমরা কোনোদিনও পাইনি। সবাই ওই পাশ থেকেই চলে যায়।’

ইজিবাইক চালক দুলাল শেখ জানান, ‘একগাদি ( অসংখ্য) ভাটা। রাস্তায় মিনিটে মিনিটে ভাটার গাড়ি চলে। একমাত্র রাস্তাটিও ভেঙে গেছে, কিন্তু সারার ( মেরামত) নাম নাই।’

নাম প্রকাশ না করা শর্তে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী বলেন,‘ কুমারখালীর মানুষ হয়েও নদীর কারণে উপজেলা শহর কোনোদিন দেখা হয়নি। সবকিছু পাবনা থেকেই করা হয়।’

স্থায়ী বাসিন্দা মুকুল হোসেন জানান, ‘উপজেলায় যেতে আসতেই একদিন চলে যায়। কেউ অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না। পুলিশ আসে না। নানান সমস্যা মানুষের। অথচ মাত্র তিন কিলোমিটার দুরে পাবনা শহর।’

সাদিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. বদর উদ্দিন জানান, ‘এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র নদীর ওপারে। নদীপথে বাড়ি থেকে সময়মতো কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারে না শিক্ষার্থীরা। সেজন্য ভাড়া বাসায় থেকে পরীক্ষা দেয় অনেকে। তবে তা ব্যয়বহুল হওয়ায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে অনেক শিক্ষার্থী পাবনা জেলার স্কুলে চলে যায়।

ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান পরিবেশ। চিকিৎসক একাই বসে আছেন। এসময় কমপ্লেক্সের উপ সহকারী মেডিকেল অফিসার মো. হেলাল উদ্দিন জানান, হাসপাতালে চারটি পদের তিনটিই শূন্য। ওষুধ থাকলেও রোগী তেমন আসে না। পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকা না থাকায় গর্ভবতী মহিলাদের সেবা ব্যাহত হচ্ছে।

চরসাদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. সোহেল রানা জানান, প্রতিদিন চর পাড়ি দিয়ে আসতে অনেক কষ্ট হয়। যখন নদীতে পানি থাকে, তখন জান ঠোঁটের ওপর থাকে। তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের পাশাপাশি সেখানে পুলিশ ক্যাম্প, পোস্ট অফিস ও ব্যাংক স্থাপনের দাবি জানান।

পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মেছের আলী জানান, ‘নদীটি মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে আছে। নদীর কারণেই মানুষের জীবনমান এখনও অনুন্নত। এসব নিয়ে বহুবার ইউএনও, ডিসি, এমপিদের সাথে কথা বলেছি। কোনো লাভ হয়নি।’

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার দাস জানান, ‘কৃষিখাতকে আধুনিকায়নের লক্ষ্যে ২০২১ - ২০২২ অর্থবছর থেকে অর্ধেক ভর্তুকি মূল্যে সরকার কৃষকদের মাঝে নানান যন্ত্রপাতি বিতরণ করে আসছে। কিন্তু উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে আজ পর্যন্ত কোনো যন্ত্রপাতি বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। তবে প্রণোদনার বীজ ও সার দেওয়া হয়ে থাকে।’

ইউএনও মো. মাহবুবুল হক জানান, ‘পদ্মার দুর্গমচরে অবস্থিত সাদিপুর ইউনিয়ন। নৌকা তাদের একমাত্র যানবাহন। সেজন্য সেখানকার মানুষ নানামুখী সেবা থেকে বি ত হচ্ছে। তবে বাসিন্দারা যদি জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে লিখিতভাবে জানায়, সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে।’

জেলা প্রশাসক মো. এহেতেশাম রেজা জানান, ‘নদীতে সেতু নির্মাণ বা ফেরি চলাচল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে তিনি মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য সেবাক্যাম্প চালু করা প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।’

চরসাদিপুর ইউনিয়ন বাসীর ভাগ্যবদল ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য কার্যকারী পরিকল্পনা চলছে বলে জানান কুষ্টিয়া ৪ আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ।

বাংলাদেশ সময়: ১৪:২০:২৯ ● ১৮১ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ