কৌশলে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে চৌকস কর্মকর্তা

Home Page » জাতীয় » কৌশলে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে চৌকস কর্মকর্তা
মঙ্গলবার ● ৫ মার্চ ২০২৪


ফাইল ছবি

বঙ্গনিউজঃ     অপরিকল্পিত ও কৌশলী বদলির কারণে একে একে তুখোড় ও সাহসী কর্মকর্তাশূন্য হয়ে পড়ছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়। চৌকস কর্মকর্তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কম দুর্নীতি হয় এমন এলাকায়। যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতির বড় বড় অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছেন– তাদের কপালেই জুটছে বদলির খড়্গ। দক্ষ, অভিজ্ঞ, সাহসী কর্মকর্তা সরিয়ে দেওয়ার পেছনে প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজদের হাত থাকতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

তারা বলেছেন, ঢাকার বাইরেও দুদকের দক্ষ কর্মকর্তার প্রয়োজন আছে– এটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। তবে তা যদি হয় বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য, সে ক্ষেত্রে দুদক নিজেই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দুদকের প্রধান কার্যালয়ে বদলি হয়ে আসছেন আনকোরা কর্মকর্তা। তাদের বেশির ভাগেরই নেই দক্ষতা। বড় বড় দুর্নীতি অনুসন্ধানেও নেই অভিজ্ঞতা। এ ছাড়া দুদকে প্রেষণে আসা কিছু পদস্থ কর্মকর্তা যেখান থেকে বদলি হয়ে এসেছেন, সেখানকার দুর্নীতিবাজদের রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছেন। এ কারণে তারা দক্ষ কর্মকর্তাদের ‘পথের কাঁটা’ মনে করছেন। চৌকস কর্মকর্তাকে বদলির পেছনে প্রেষণে আসা ওই সব কর্মকর্তারও ‘কূটচাল’ থাকতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

সূত্র জানায়, দুদকের প্রধান কার্যালয় হবে অনুসন্ধান ও তদন্তে পারদর্শী কর্মকর্তাদের মুখ্য স্থান। এখান থেকেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা পৌঁছাবে সারাদেশে। সে ধরনের দৃষ্টান্ত তৈরির স্থান হিসেবে প্রধান কার্যালয়কে না সাজিয়ে কাজের ক্ষেত্রে দুর্বল করে রাখা হচ্ছে।

সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি প্রেষণে আসা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বকাউল স্বাক্ষরিত এক আদেশে সাত কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়। এর মধ্যে গোয়েন্দা ইউনিটের উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান এবং বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-১ শাখার উপপরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রধান কার্যালয় থেকে বদলি করা হয়। মশিউর রহমানের হাতে ছিল কিছু প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজের নথি। অনুসন্ধান ও তদন্তেও রয়েছে তাঁর বিশেষ দক্ষতা। আর সৈয়দ নজরুল ইসলাম এরই মধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কিছু ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্জ কোম্পানির ডলারসহ অন্য বৈদেশিক মুদ্রা কারসাজির তথ্য উদ্ঘাটন করে আলোচনায় আসেন। তিনি ঢাকা ওয়াসার বর্তমান এমডির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করছিলেন। এ পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ওই দুই কর্মকর্তাকে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

তারা দু’জন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংগঠন দুদক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (ডুসা) নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দুদকের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে অপসারণের ঘটনায় এ দুই কর্মকর্তা সহকর্মীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সারাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শরীফ উদ্দিনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি ওই সময় দুদক ভালোভাবে নেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, তারই রোষানলের শিকার হয়েছেন বেশ কিছুসংখ্যক চৌকস কর্মকর্তা। এর মধ্যে উপপরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী ও মো. সালাহউদ্দিন অন্যতম।

গত ২ জানুয়ারি প্রশাসন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বকাউল স্বাক্ষরিত আরেক আদেশে প্রধান কার্যালয়ের অত্যন্ত চৌকস উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানকে ময়মনসিংহ কার্যালয়ে বদলি করা হয়। তিনি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ভারতে গ্রেপ্তার পি কে হালদারসহ ৭৫ জনের নামে ৫২টি মামলা করেছেন। তিনি বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি মামলার তদন্তসহ বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করেছেন। সর্বশেষ গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি।

দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মাসুদুর রহমান কমিশনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের মূল ডেস্কের উপপরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। ঢাকাসহ সারাদেশে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালানোয় তাঁর রয়েছে বিশেষ দক্ষতা। গত ২ জানুয়ারির আদেশে তাঁকে দুদকের চাঁদপুর কার্যালয়ে বদলি করা হয়।

পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বকাউল স্বাক্ষরিত গত ২২ জানুয়ারির আদেশে বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-২ শাখার উপপরিচালক মো. মোনায়েম হোসেনকে কমিশনের প্রসিকিউশন শাখায় বদলি করা হয়।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারির এক আদেশে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১-এর পরিচালক এস এম এম আখতার হামিদ ভূঞাকে বদলি করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে। তিনি সততা ও দক্ষতার সঙ্গে বড় বড় অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্তে সাফল্য দেখিয়েছেন।

ক্যাসিনোকাণ্ডসহ বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করে আলোচনায় আসা দুদকের মহাপরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে নিষ্ক্রিয় করে কমিশনের প্রশিক্ষণ ও আইসিটি অনু বিভাগে বদলি করা হয়েছে। এর আগে তিনি দুদকের বিশেষ তদন্ত-২ শাখায় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এভাবে গত দেড় থেকে দুই বছরে কর্মকর্তা বদলির ৮ থেকে ১০টি আদেশ জারি করে দুদক। ওই সব আদেশে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে বেশ কিছুসংখ্যক দক্ষ, অভিজ্ঞ, সাহসী কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

দুর্নীতি দমন ব্যুরো থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দিকে কমিশন রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে কার্যকরভাবে কাজ করতে পারেনি। ২০০৭ সালে বিলুপ্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কমিশনের দ্বিতীয় চেয়ারম্যান সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদের নেতৃত্বে দুদকের দুর্নীতিবিরোধী নানামুখী পদক্ষেপ দুর্নীতি দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাজনৈতিক সরকারের সময় কমিশনের তৃতীয় চেয়ারম্যান গোলাম রহমান, চতুর্থ চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান ও পঞ্চম চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের সময় দুদকের দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম প্রশংসা পায়।

জানা গেছে, একসময় দুদকে সামরিক বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, বিচার বিভাগ, ব্যাংকার, এনবিআর, প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরের দক্ষ ও চৌকস কর্মকর্তা তদারকি ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করে দুদককে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে জনআস্থা অর্জনে সমর্থ হয়েছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুর্নীতিবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি বলেন, কয়েক বছরে দুদকে একচ্ছত্রভাবে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের একক পদচারণায় দুদক অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়েছে। দেশে দুর্নীতির মাত্রা বাড়লেও দুদকে দুর্নীতির অভিযোগ গ্রহণের হার কমেছে। বিশেষ করে অভিযোগ যাচাই-বাছাই পর্যায়ে দুদকের এখন যাচ্ছেতাই অবস্থা। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়া হবে, কার বিরুদ্ধে নেওয়া হবে না– এটি চলছে প্রশাসন ক্যাডারের প্রেষণে আসা কর্মকর্তাদের মর্জি-মাফিক। তারা দুর্নীতির অভিযোগ প্রাথমিক পর্যায়ে বাদ দিয়ে দিচ্ছেন।

বদলির বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ বদলি যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ও নীতি অনুসরণ করে হয়, তাহলে কোনো প্রশ্ন থাকবে না। তবে যারা দক্ষ কর্মকর্তা, যারা গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ অনুসন্ধান, তদন্ত করছিলেন– তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পন্ন করার আগেই যদি বদলি করা হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে, কোনো কোনো বিশেষ মহলকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এটি করা হচ্ছে কিনা।

---

তিনি আরও বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুদকের কার্যক্রমে এক ধরনের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক চাপ জোরালোভাবে দেখা যাচ্ছে। তাতে দুদকের মতো প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহির লেশমাত্র থাকছে না। দুদক কেন এভাবে বদলি করছে, সেটা যদি প্রকাশ করা হয়, তাতে মানুষের আস্থার একটা জায়গা তৈরি হতে পারে। যেহেতু দুদক এটা করছে না, তাই প্রশ্ন থেকেই যাবে।
দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. বদিউজ্জামান বলেন, দুদক যে তাদের ভালো বোঝে না, এমন না। এটি তাদের নিজস্ব প্রশাসন। তবে তারা কারও অঙ্গুলির নির্দেশে এসব করছে, নাকি নিজে থেকে করছে– এটা তো জানি না।

তিনি বলেন, এবারের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিভিন্ন নেতা-মন্ত্রীর নামে সম্পদের অস্বাভাবিক তথ্য এসেছে গণমাধ্যমে। এ নিয়ে দুদক তাদের একটা নোটিশ তো অন্তত দিতে পারত; জিজ্ঞাসা করতে পারত। সেটি করা হলো না। আগে কমিশন প্রতিবছর বিভিন্ন খাতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির উপস্থিতিতে একটা সেমিনার করত। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতারাও সেমিনারে অংশ নিতেন। বড় বড় ব্যবসায়ীও আসতেন। তারা তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করার সুযোগ পেতেন। বর্তমান কমিশনের আগের কমিশন ওই সেমিনার বন্ধ করে দিয়েছে।

দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের প্রধান কার্যালয় থেকে বদলি করে কমিশনের কেন্দ্রস্থলকে দুর্বল করছেন কেন– এ প্রশ্নে দুদক কমিশনার মো. জহুরুল হক বলেন, একটি কর্মস্থলে কোনো কর্মকর্তার তিন বছর হয়ে গেলে তাদের বদলি করার নিয়ম আছে। তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়। প্রয়োজনে কোনো কর্মকর্তার তিন বছর হলেও তাঁকে রেখে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১:০১:০৩ ● ১৭৭ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ