বঙ্গনিউজঃ শুল্ক ছাড়ের সুযোগ নেওয়ার ধান্ধায় বন্দর থেকে খেজুর খালাসে ‘ধীরে চল’ ফন্দি এঁটেছিলেন আমদানিকারকরা। তবে কমেনি ‘মনের মতো’ শুল্ক। এদিকে রোজাও দরজায় কড়া নাড়ছে। ফলে তাদের প্রত্যাশার ফানুস অনেকটাই চুপসে গেছে। এখন খেজুর খালাসে আমদানিকারকরা আদাজল খেয়ে নেমে পড়ায় দেখা দিয়েছে বিপত্তি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ কম দরের খেজুরেও বেশি দাম হিসাব করে শুল্কায়ন করছে। খালাস কার্যক্রমেও কাস্টমসের রয়েছে মন্থর গতি। তাতে বন্দরে আটকে গেছে খেজুরভর্তি হাজারের বেশি কনটেইনার। বন্দর থেকে খেজুর খালাস দেরি হওয়ায় সরবরাহ ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে কিছুটা জটিলতা, যা দাম উস্কে দিচ্ছে।
বছরের অন্য সময়ের চেয়ে রমজানে খেজুরের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। কয়েক বছর ধরে নানা ছুতায় চাহিদা বাড়ার এ সুযোগকে কাজে লাগান কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। যদিও এবার শুল্কহার কিছুটা বেশি, তবু নানা কারণে বাজারে এখন খেজুরের ‘আগুন দর’। কিছুটা কমানোর পরও শুল্কহার বেশি থাকা ও ডলারের দর বাড়ার কারণে সব ধরনের খেজুরের দাম গেল বছরের চেয়ে ১০০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়েছে।
আমদানিকারকদের অভিযোগ, চার-পাঁচ মাস আগে থেকে খেজুরের শুল্ক কমানোর অনুরোধ করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এর পর প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেওয়ার পরও দুই সপ্তাহ গড়িমসি করা হয়েছে শুল্ক কমাতে। এত কিছুর পরও এখন শুল্কায়ন নিয়ে কাস্টমসের বাড়াবাড়ির কারণে দ্রুত খালাস করা যাচ্ছে না। যাচাই-বাছাইয়ের নামে চলছে হয়রানি। এক দিনে যে খেজুর খালাস হওয়ার কথা, তা করতে সময় লাগছে চার-পাঁচ দিন।
তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, সরকারের শুল্ক ছাড়ের সুযোগ নিতে বন্দরকে গুদাম বানিয়ে যারা খেজুর ধরে রেখেছেন, তারা সবাই বড় ব্যবসায়ী।
২৫ শতাংশের বদলে সরকার শুল্ক ছাড় দিয়েছে ১০ শতাংশ। রোজাও কাছাকাছি চলে এসেছে। তাই আমদানিকারকরা এখন সবাই একসঙ্গে খেজুর খালাসে তোড়জোড় করছেন। মূলত যারা বেশি শুল্ক ছাড়ের আশায় খেজুর খালাস করেননি, তাদের পণ্যই জট লেগে আছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার সুলতান আরেফিন বলেন, শুল্ক ছাড়ের অপেক্ষা না করে অনেকেই পণ্য ছাড় করে নিয়ে গেছেন। যারা ইচ্ছা করে এতদিন খেজুর খালাস করেনি, তাদের পণ্যের জট লেগেছে। শুল্কায়নে কাউকে কোনো ধরনের হয়রানি করা হচ্ছে না। সবাই যদি একসঙ্গে সব পণ্য এক দিনে শুল্কায়ন করতে চায়, তাহলে তো পরিস্থিতি জটিল হবে।
কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা জহুরুল ইসলাম বলেন, বন্দরে যাদের পণ্য জমে আছে, তারা সবাই রাঘববোয়াল। তারা বেশি লাভের আশায় এতদিন পণ্য খালাস করেননি। এখানে কাস্টমসের কোনো দায় নেই। প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ কনটেইনার পণ্য খালাস হচ্ছে। যেখানে ১৫ দিন আগে খালাস হয়েছিল দিনে মাত্র ৫ থেকে ১০ কনটেইনার।
১৯ ডিপোতে আটকা খেজুরভর্তি কনটেইনার
চট্টগ্রামের ১৯ বেসরকারি ডিপোতে খেজুরভর্তি প্রায় এক হাজার কনটেইনার আছে। এসব কনটেইনারে অ্যারাবিয়ান ডেটস ফ্যাক্টরি, রয়েল ফ্রেশ ফুডস, সাপোয়ানা ফুড ট্রেডিং করপোরেশন, মদিনা ফুডস, রামিসা বিডি, রয়েল ফ্রেশ ফুডস, এডি ফ্রুটস ও আল্লাহর রহমত স্টোরের সবচেয়ে বেশি খেজুর রয়েছে।
১৯ ডিপোর মধ্যে পোর্ট লিঙ্ক লজিস্টিকে আছে ২০ ফুট দীর্ঘ সর্বাধিক ৩৯২ একক কনটেইনার। এছাক ব্রাদার্সে ২৮২ একক কনটেইনার রয়েছে। ইস্টার্ন লজিস্টিকে আছে ৫০ একক কনটেইনার। বাকি কনটেইনার আছে অন্যান্য ডিপোতে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সচিব রুহুল আমীন সিকদার বলেন, অতীতে কখনও রমজানের আগে এত বেশি সংখ্যক কনটেইনার ডিপোতে জমেনি।
খালাসে কেন দেরি
জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর ও বিভিন্ন ডিপোতে খেজুরভর্তি কনটেইনার পড়ে আছে প্রায় এক হাজার। এর মধ্যে চার শতাধিক কনটেইনার পড়ে আছে দুই মাস ধরে। খেজুর খালাসে নিয়োজিত থাকা অন্যতম শীর্ষ সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান সোনারগাঁ অ্যাসোসিয়েটসের কর্ণধার চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলামের প্রায় ২০০ কনটেইনার ও রয়েল ফ্রেশের ১০০ কনটেইনার খেজুর রয়েছে তাঁর ডিপোতে। গত ৩ জানুয়ারি এসব খেজুরভর্তি কনটেইনার দেশে আসে। প্রতিটি কনটেইনারে ২৪ থেকে ২৬ টন খেজুর আছে। শুল্কায়ন জটিলতার কারণে পণ্য খালাসে দেরি হয়েছে।
সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান আমানত ট্রেডার্সের মালিক আবুল কালাম আজাদ জানান, তাঁর কাছে মদিনা গ্রুপ ও নাসা গ্রুপের প্রায় ১৫০ কনটেইনার খেজুর আটকে ছিল। এখন কিছুটা খালাস হচ্ছে।
চাহিদার অর্ধেক রমজানে
দেশে বছরে খেজুরের চাহিদা রয়েছে প্রায় এক লাখ টনের। এর অর্ধেকের বেশি, অর্থাৎ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন দরকার হয় রমজানে। তবে এ চাহিদার পুরোটাই মেটাতে হয় আমদানির মাধ্যমে। ফলে আমদানিতে কোনো প্রভাব পড়লেই তা দাম বাড়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। সাধারণত সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরাক, ইরান, তিউনিসিয়া, জর্দান ও আলজেরিয়া থেকে প্রায় ২৮ জাতের খেজুর দেশে আসে।
খেজুরের দর বেড়েছে ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ
খেজুরের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এ মাসেই আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়েছে সরকার। তবে বাজারে এর তেমন প্রভাব দেখা যায়নি। সরকারি সংস্থা টিসিবির তথ্য বলছে, গত বছর এ সময় সাধারণ মানের খেজুরের সর্বনিম্ন দর ছিল ১৫০ টাকা, যা এখন ২৫০ টাকা। সংস্থাটির তথ্যমতে, এক বছরে খেজুরের দর বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। যদিও বাজারের বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। গতকাল সোমবার ঢাকা ও চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছর সাধারণ মানের খোলা খেজুরের কেজি বিক্রি হয়েছিল ১২০ থেকে ১৩০ টাকায়। এবার তা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা। বাজারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় জাহিদি জাতের খেজুর। এক বছর আগে এই জাতের খেজুর পাওয়া যেত ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায়। এখন গুনতে হচ্ছে ২৭০ থেকে ৩০০ টাকা।
অভিজাত শ্রেণির খেজুরের মধ্যে আজওয়া, মরিয়ম, মাবরুম ও মেডজুল অন্যতম। এর মধ্যে গত বছরে প্রতি কেজি আজওয়া ও মরিয়ম খেজুরের দর ছিল ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। এবার এ দু’জাতের খেজুর কিনতে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা। এ ছাড়া গত বছরের চেয়ে মেডজুল খেজুরের কেজিতে ৪০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা।
ঢাকার কারওয়ান বাজারের খেজুর ব্যবসায়ী মো. হানিফ বলেন, ডলারের দাম ও শুল্ক হার বেড়েছে। এ জন্য গত বছরের চেয়ে খেজুরের দাম প্রায় ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি। দাম বাড়ার কারণে মানুষ খেজুর কম কিনছেন।
খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ছৈয়দ ছগীর আহমেদ বলেন, সরকার শুল্ক ছাড় দিলেও খেজুরে এর প্রভাব নেই বললেই চলে। তবে বন্দরে পড়ে থাকা খেজুর যথাসময়ে খালাস হলে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজারে।
খেজুরে নির্ধারিত শুল্কহার
এই অর্থবছরের শুরুতে খেজুর আমদানিতে মোট ৫৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো ব্যবসায়ীদের। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খেজুরের শুল্কায়ন মূল্য এখন প্রতি টন ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৭৫০ ডলার। এর সঙ্গে কাস্টমস ডিউটি ১৫ শতাংশ, রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ ও ভ্যাট ১৫ শতাংশ আছে। পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর ও অগ্রিম কর দিতে হচ্ছে ৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে এখনও ৪৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হচ্ছে।
আমদানিকারকরা যা বলছেন
সবচেয়ে বেশি কনটেইনার রয়েছে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম, মদিনা গ্রুপের হাজি সেলিম ও নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের।
কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পণ্য খালাসে আমদানিকারকদের হয়রানি করছে বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, গত বছরের তুলনায় প্রতি ডলারে অতিরিক্ত ২৫ থেকে ৩০ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। তবু কাস্টমস কর্মকর্তারা নিজেদের ইচ্ছামতো অ্যাসেসমেন্ট ভ্যালু নির্ধারণ করছেন। দেখা যাচ্ছে, এক হাজার ডলার দিয়ে যে খেজুর আমদানি করা হয়েছে, কাস্টমস তার মূল্য আড়াই হাজার ডলার ধরে শুল্কায়ন করছে। এতে খালাস কার্যক্রমে দেরি হচ্ছে। এক দিনে যে পণ্য খালাস করা যেত, তা করতে এখন সময় লাগছে চার-পাঁচ দিন। এতে খরচের বোঝা বাড়ছে আমদানিকারকদের। তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেওয়ার পরও শুল্ক কমানোর ক্ষেত্রে গড়িমসি করেছে এনবিআর। বন্দরে জট লাগার পেছনে এটিও একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।
শুল্কহার আরও কমানো দরকার ছিল মন্তব্য করে এ ব্যবসায়ী জানান, কার্টন আকারে আমদানি করা প্রতি কেজি খেজুর মানভেদে এখন শুল্ক দিতে হচ্ছে ১৪০ থেকে ২০৮ টাকা। যা গত বছর দিতে হয়েছিল মাত্র ১০ টাকা ৫৮ পয়সা। তাঁর ৪০ কনটেইনার দামি খেজুর খালাস করতে এবার সাড়ে আট কোটি টাকা শুল্ক দিতে হয়েছে। গত বছর এ পরিমাণ খেজুরে তিনি শুল্ক দিয়েছিলেন ৭০ লাখ টাকা।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ডেটস অ্যান্ড ড্রাই ফ্রুটস আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান তৈয়বিয়া এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ওমর ফারুক বলেন, কিছু খেজুর বন্দরে আটকে থাকায় বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে।