বঙ্গনিউজঃ ডলার সংকটের নেতিবাচক প্রভাব প্রায় সব খাতেই পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পড়েছে ব্যাংক ও শিল্প খাতে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রায় বিধিবদ্ধ তারল্য বা টাকা জমা রাখার হার কমেছে।
ডলার সংকটের আগে ব্যাংকগুলোর মোট তারল্যের সোয়া ৫ শতাংশ রাখত বৈদেশিক মুদ্রায়। তীব্র সংকটের সময় এ হার পৌনে ২ শতাংশে নেমে এসেছিল। বর্তমানে কিছুটা বেড়ে আড়াই শতাংশ ছাড়িয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রায় জমার হার কমার কারণে জরুরি প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিজস্ব ডলার এনে সংকট মোকাবিলা করার সক্ষমতাও কমেছে ব্যাংকগুলোর।
সূত্র জানায়, গ্রাহকদের নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা রাখতে হয়। এর মধ্যে প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের ১৩ শতাংশ স্ট্যাটুটারি লিকুইডিটি রেশিও বা এলএলআর হিসাবে ও ৪ শতাংশ ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর হিসাবে সংরক্ষণ করতে হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলোর এ হার সাড়ে ৫ শতাংশ ও ৪ শতাংশ। এর মধ্যে সিআরআর পুরোটাই নগদ আকারে রাখতে হয়। এসএলআর নগদ আকারে বা বিভিন্ন বন্ডে বিনিয়োগ করে বা বৈদেশিক মুদ্রা আকারে যে কোনো ভাবেই রাখা যায়। বৈদেশিক মুদ্রায় কোনো অংশ রাখতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বেশি থাকলে তারা এগুলোতেও এসআলআর জমা রাখে। কারণ এতে ব্যাংকের ওপর তারল্যের চাপ কমে যায়। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার বাড়ানো সম্ভব হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, মোট তারল্যের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় বেশি সংরক্ষণ করত সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। এখন এসব ব্যাংকেই সবচেয়ে বেশি কমেছে বৈদেশিক মুদ্রায় জমার হার। এখন তুলনামূলকভাবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রায় জমা সংরক্ষণ হার বেশি।
ডলার সংকট শুরু হয় ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে। এর আগে ব্যাংকগুলোতে ডলারের প্রবাহ বেশি ছিল। ফলে ওই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রায় তারল্য সংরক্ষণের হারও ছিল বেশি। সংকট শুরু হলে বৈদেশিক মুদ্রা জমা রাখার প্রবণতাও কমতে থাকে। ব্যাংকগুলোতে মোট আমানত বাড়ার পাশাপাশি বিধিবদ্ধ আমানত রাখার হারও বেড়েছে। এর বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রায় জমার হারও বাড়ার কথা। কিন্তু তা না বেড়ে কমেছে। তবে এখন ডলার সংকটের তীব্রতা কিছুটা কমার কারণে এখন এ হার আবার কিছুটা বাড়তে শুরু করেছে।
২০২০ সালের মে মাসে ব্যাংকগুলোতে মোট তারল্য ছিল ৩ লাখ ৭ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ছিল ১৫ হাজার ৯০১ কোটি টাকা। যা মোট তারল্যের ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এটাই ছিল সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রায় সংরক্ষণের হার। এরপর থেকেই এ হার কমতে থাকে। একই বছরের জুলাইয়ে মোট তারল্য ছিল ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ছিল ১৪ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। যা কমে মোট তারল্যের ৪ দশমিক ৩১ শতাংশে দাঁড়ায়। একই বছরের ডিসেম্বরে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ১৪ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ছিল ১৫ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। যা আরও কমে মোট তারল্যের ৩ দশমিক ৭৬ শতাংশে নামে।
২০২১ সালের জুনে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ছিল ১১ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা। যা মোট তারল্যের ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ওই সময়ে মোট তারল্য বাড়লেও বৈদেশিক মুদ্রায় জমার হার বাড়েনি। একই বছরের ডিসেম্বরে মোট তারল্য ছিল ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ছিল ৮ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। যা মোট তারল্যের ২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
ওই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রায় জমার হার কমার কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, করোনার পর ২০২১ সালে বৈশ্বিকভাবে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বেড়ে যায় আমদানি ব্যয়। এর প্রভাবে ডলারের চাহিদা বাড়ায় এতে জমা কমেছে।
২০২২ সালের এপ্রিল থেকে ডলার সংকট শুরু হয়। ফলে ব্যাংকগুলো ডলার ব্যবহারে সতর্ক হয়। ওই বছরের জুনে ব্যাংকগুলোতে মোট তারল্য আগের চেয়ে কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৪১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকায়। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় সংরক্ষণের পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮১৪ কোটি টাকায়। যা মোট তারল্যের ১ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ওই সময়েই বৈদেশিক মুদ্রায় তারল্য সংরক্ষণের হার সবচেয়ে কম ছিল। এরপর থেকে এ হার কিছুটা বাড়তে থাকে। তবে ডলারে বাড়ার চেয়ে টাকায় বেশি বেড়েছে। কারণ ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ফলে টাকার জমার স্থিতি বেড়েছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোতে মোট তারল্য কিছুটা কমে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ছিল ৮ হাজার ৪১১ কোটি টাকা। যা মোট তারল্যের ২ দশমিক ১৪ শতাংশ।
২০২৩ সালের জুনে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ২১ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ছিল ১২ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা। যা মোট তারল্যের ৩ দশমিক ০২ শতাংশ। একই বছরের ডিসেম্বরে মোট তারল্য ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার ১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রায় ছিল ১১ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। যা মোট তারল্যের ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
সূত্র জানায়, বৈদেশিক মুদ্রায় কিছু বিধিবদ্ধ আমানত জমা থাকলে ব্যাংকগুলো জরুরি প্রয়োজনে ওইসব ডলার এনে চাহিদা মেটাতে পারে। এ খাতে জমা কমলেও বৈদেশিক মুদ্রা খাতে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতায়ও টান পড়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ বাড়াতে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার ধার করার পদ্ধতি চালু করায় এখন এ খাতে জমার প্রবণতা আরও কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।