বঙ্গনিউজঃ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে গড়ে উঠেছে ছাত্রলীগের কতিপয় নেতাকর্মীর অপরাধ সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটে আছে বহিরাগতরাও। এরা চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, জমি দখলসহ নানা অপকর্মে জড়িত। কিছুদিন পরপরই এ অপরাধ সিন্ডিকেটের অপকর্ম সামনে আসে।
কিন্তু কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় সিন্ডিকেটের সদস্যরা দিনে দিনে বেপরোয়ার হয়ে উঠছে। সর্বশেষ শনিবার রাতে মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষে বহিরাগত এক ব্যক্তিকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। যার জেরে এখন উত্তাল বিশ্ববিদ্যালয়। এ ঘটনার নায়ক বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান। সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকরা মোস্তাফিজ ও তার সহযোগীদের বিচার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।
এদিকে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় স্বামীর করা মামলায় মোস্তাফিজুর রহমানসহ ৪ জন ৩ দিনের রিমান্ডে রয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদে মোস্তাফিজ ওই নারীকে পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। ঘটনার মাস্টারমাইন্ড মামুনুর রশিদ মামুন এবং অপর আসামি মুরাদ হোসেন পুলিশের নজরদারিতে রয়েছে। তারা যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারে।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ হিল কাফী বলেন, মামলার অপর দুই আসামিকে গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত আছে। যে কোনো সময় আমরা ভালো খবর জানাতে পারব। তিনি জানান, মোস্তাফিজুরসহ চারজনকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বিস্তারিত জানানো যাবে।
এ ধরনের অপকর্মের বিষয়ে ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল বলেন, ‘আমরা অপরাধীদের প্রশ্রয় দেই না, দেবও না। ধর্ষণের ঘটনায় এরইমধ্যে জড়িতদের সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। ধর্ষকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই। এই ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেজন্য দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানাই।’
ভুক্তভোগীরা জানান, জাহাঙ্গীরনগর ও আশপাশ এলাকায় এমন কোনো অপকর্ম নেই যা ছাত্রলীগের নামে হয় না। জাহাঙ্গীরনগরের বিভিন্ন দোকানপাট থেকে মাসোহারা আদায়, বিশমাইল এলাকার পরিবহণ টিকিট কাউন্টার থেকে চাঁদা আদায়, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে চলাচলরত বিভিন্ন পরিবহণ থেকে চাঁদা আদায় হয় ছাত্রলীগের নামে। এছাড়া ক্যাম্পাসে মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, শিক্ষার্থীদের মারধর, বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের মারধর, শিক্ষকদের অপদস্ত করা, সাংবাদিক নির্যাতনসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য কিছু দিন পরপর গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ।
ধর্ষণসহ নানা অপরাধের প্রতিবাদে মঙ্গলবার জাবি ক্যাম্পাসে মানববন্ধন হয়েছে। এতে অর্ধশতাধিক শিক্ষক ও শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।
মানববন্ধন থেকে নিরাপদ ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। এই কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনিছা পারভীন জলী বলেন, ‘আমরা বারবার দেখেছি যে কোনো আন্দোলনের সময় উপাচার্য আশ্বাস দেন। কিন্তু আশ্বাস বাস্তবায়ন করেন না। যেমনটি আমরা মাহমুদুর রহমান জনির ক্ষেত্রে দেখেছি। দেড় বছর পার হয়ে গেলেও যৌন নিপীড়নের দায়ে জনিকে শাস্তি দেওয়া হয়নি। বহিরাগত নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীদের ধরতে প্রক্টর, প্রভোস্ট না গিয়ে তারা দুজন ছাত্রলীগ নেতাকে পাঠান। এর মধ্য দিয়ে প্রক্টর, প্রভোস্ট তাদের পদে থাকার নৈতিক অবস্থান হারিয়েছেন।’
জানা যায়, জাবি ছাত্রলীগ প্রথমবারের মতো আলোচনার শীর্ষে আসে ১৯৯৮ সালে। তৎকালীন শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিক শততম ধর্ষণ করে মিষ্টি বিতরণ করেছিলেন। সেই সময় বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে নানা টালবাহানার পর জাবি প্রশাসন তাকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয়। এরপর ক্যাম্পাসটিতে আরও অনেকবার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। তাতে নাম এসেছে ছাত্রলীগের। এবারও ঘটেছে একই ঘটনা। জাবি ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সম্পাদক ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান জড়িয়েছে ধর্ষণকাণ্ডে। সে শনিবার সন্ধ্যার পর মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষে বহিরাগত এক ব্যক্তিকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে বোটানিক্যাল গার্ডেনসংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বামী বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় ছয়জনকে আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে মোস্তাফিজসহ চারজন গ্রেফতারের পর ৩ দিনের রিমান্ডে রয়েছে।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে সাভারের একটি রেস্টুরেন্টে বসাকে কেন্দ্র করে মীর মশাররফ হোসেন হল ও কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল শাখা ছাত্রলীগের মধ্যে দফায় দফায় অস্ত্রের মহড়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একই বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর খিলগাঁও এলাকায় চলন্ত বাসে লক্ষ্মীপুরের এক যুবককে অচেতন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ সালাম-বরকত হলে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সেখানে তাকে নির্যাতন এবং ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ ওঠে জাবি শাখা ছাত্রলীগের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক অসীত পালের বিরুদ্ধে। একই বছরের ৬ এপ্রিল এসবি সুপার নামের একটি বাস আটকে দুই লাখ টাকা দাবি করে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক শেখ রাজু।
২০২৩ সালের আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ক্যাম্পাসে ছিনতাইয়ের শিকার হন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) এক সহকারী অধ্যাপক। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের দুই নেতাকর্মীর জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। একই বছরের এপ্রিলে বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ আলম তালুকদারের সিএন্ডবি এলাকার নার্সারি থেকে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে জাবি ছাত্রলীগের উপ-সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনসহ আরও কয়েকজন নেতা। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তারা নার্সারিতে তালা ঝুলিয়ে দেয়। একই বছরের অক্টোবরে শহিদ রফিক-জব্বার হলে এক ক্যাবল অপারেটর ইন্টারনেট বিল আনতে গেলে তাকে আটকে চাঁদা আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সাব্বির হোসেন নাহিদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান জয়।
২০২২ সালের জুনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে মারধর ও আরেক নারী শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে হেনস্তার অভিযোগ ওঠে দুই ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনার বিচার চেয়ে ভুক্তভোগীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর পৃথক দুটি লিখিত অভিযোগপত্র দিলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন।
এর আগে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে লাঞ্ছিত এবং এক সংবাদকর্মীকে মারধরের অভিযোগে ছাত্রলীগের পাঁচজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। একই বছরের নভেম্বরে এক শিক্ষার্থী ও তার বান্ধবীর কাছে চাঁদা দাবি করে ছাত্রলীগের কয়েক কর্মী।
চাঁদা না দেওয়ায় মারধর ও ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়। এরপর শিক্ষার্থীর কানের দুল ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ওই ঘটনায় ছাত্রলীগের তিন কর্মীকে আজীবন এবং দুজনকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ওই বছরের জুনে বহিরাগত এক ব্যক্তি ও তার বান্ধবীর মোবাইলফোন এবং মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তিনজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।
২০১৭ সালের জুলাইয়ে ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা হামজা রহমান অন্তরের নামে ক্যান্টিন মালিকের কাছ থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগ ওঠে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি বহিরাগত এক নারীকে ইভটিজিংয়ে বাধা দেওয়ায় শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় তিন ছাত্রলীগ কর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
আর শনিবার মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় ৬ জনের সনদ স্থগিত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া ঘটনা তদন্তে চার সদস্যদের কমিটি গঠন করা হয়েছে।