কঠোর মনিটরিংয়ের নির্দেশ কর ফাঁকি বন্ধে

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » কঠোর মনিটরিংয়ের নির্দেশ কর ফাঁকি বন্ধে
মঙ্গলবার ● ৩০ জানুয়ারী ২০২৪


কঠোর মনিটরিংয়ের নির্দেশ কর ফাঁকি বন্ধে

বঙ্গনিউজঃ    আর্থিক সংকট মোকাবিলায় রাজস্ব বাড়াতে কর ফাঁকি বন্ধে কঠোর মনিটরিংয়ের নির্দেশ দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সম্প্রতি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে বৈঠকে এ নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই বৈঠকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কৃষকের দিকে নজর দিতে বলেছেন তিনি। বিশেষ করে কৃষক, কৃষি যন্ত্রাংশ আমদানি, কৃষিজাত পণ্যের শিল্পকে গুরুত্ব দিতে বলা হয়। এটি সহনীয় পর্যায়ে আনা গেলে উৎপাদনব্যয় হ্রাস পেয়ে দ্রব্যমূল্য কমবে-এমনটি মনে করছেন অর্থমন্ত্রী। পাশাপাশি বৈদেশিক চুক্তির ক্ষেত্রে নিগোসিয়েশন সক্ষমতা বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের প্রতি জোর দিতে বলেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভাগের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসাবে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) সঙ্গে বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আইআরডির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা  জানান, বিগত সময়ে কোনো অর্থমন্ত্রী এ বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করেননি। এটিই প্রথম কোনো অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক। যদিও আইআরডি রাজস্ব আহরণ, জাতীয় সঞ্চয়পত্র, ট্যাকেসস অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে কাজ করছে।

অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে রোববার এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আইআরডির সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে জাতীয় সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন উইংয়ের সদস্য, ট্যাক্সেস অ্যাপিলেট ট্রাইবুনালের প্রেসিডেন্টসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ওই বৈঠকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। সর্বশেষ রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতিও দেখানো হয়েছে। অবশ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম ৬ মাসে বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার মাত্র সাড়ে ৩৮ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে। অন্যদিকে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, এর চেয়ে ২৩ হাজার ২২৭ কোটি টাকা কম আদায় হয়। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিল এমন একটি সূত্র জানায়, অর্থমন্ত্রী রাজস্ব বাড়াতে কর ফাঁকি প্রতিরোধ করতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, অনেক করপোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি কর ফাঁকি দিচ্ছেন। এটি বন্ধ করা গেলে এ খাতে আয় বৃদ্ধি পাবে। অবশ্য একই কথা কিছুদিন আগেও সরাসরি বলেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি বলেছেন, পণ্যের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এজন্য ইএফডি মেশিন স্থাপনের পর গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে ভ্যাট আদায় হচ্ছে প্রত্যেক দোকান থেকে, যা আগে ছিল ৪-৫ হাজার টাকা।

কর ফাঁকি রোধ নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা চলছে। সর্বশেষ কয়েকটি বড় কর ফাঁকির ঘটনা উদ্ঘাটন করেছে বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) অফিস। তাদের শনাক্তের ঘটনায় দেখা যায়, বিভিন্ন কৌশলে ১৭০ কোটি টাকার বেশি কর ফাঁকি দিয়েছে সরকারি ও বেসরকারি ২০টি প্রতিষ্ঠান। অনুমোদন ছাড়া এবং অনুমোদনসীমার অতিরিক্ত ব্যয় করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু আয় নিরূপণের ক্ষেত্রে কৌশলে এসব ব্যয়কে গোপন রাখা হয়। সরকারের বিপুল অঙ্কের এই কর ফাঁকি দেওয়ার ঘটনাটি একাদশ জাতীয় সংসদের ‘সরকারি হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির’ বৈঠকে উঠে আসে। এ টাকা দ্রুত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশও দেওয়া হয়। কিন্তু অদ্যাবধি সেই অর্থ জমা হয়নি। এছাড়া বাকি ১৫ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আপিল বিভাগে মামলা হওয়ায় বিচারাধীন আছে। যে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আগ্রাবাদ কর সার্কেল চট্টগ্রাম অফিস (প্রায় ৫৭ লাখ টাকা), কুমিল্লা সার্কেল অফিস (৮০ লাখ টাকা) এবং কাস্টম হাউজ বেনাপোল (৫ কোটি টাকা)। আর কর ফাঁকির ঘটনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আপিল বিভাগে যে ১৫ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে (৭ কোটি ২২ লাখ টাকা), ইপিএল স্টক ব্রোকারেজ লি. (১ কোটি ২২ লাখ টাকা), নিউজিল্যান্ড ডেইরি প্রডাক্টস (৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা), মদিনা সিমেন্ট (৯৭ লাখ টাকা) এবং গুলশান কর রাজস্ব সার্কেল অফিস (প্রায় ১৯ কোটি টাকা)।

এর বাইরেও আরও অনেক প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর কর ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনায় অনেক মামলাও হচ্ছে ট্যাকসেস অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে।

কর ফাঁকি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থসচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, রাজস্ব বাড়াতে হলে প্রথমে অধিকসংখ্যক মানুষকে (কর দেওয়ার যোগ্য) করের আওতায় নিয়ে আসা এবং কর ফাঁকি বন্ধ করতে হবে। তবে অধিক মানুষকে করের আওতায় আনতে গিয়ে কর ফাঁকি প্রতিরোধের দিকে মনোযোগ কম যেন না হয়, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, কর ফাঁকি বন্ধ করতে পারলে রাজস্ব সবচেয়ে বেশি আসবে। দেখা যায়, একজন ব্যক্তি ১০ কোটি টাকা কর দেওয়ার যোগ্য। কিন্তু সেটি নানা কৌশলে দিচ্ছে মাত্র এক কোটি টাকা। আমরা মনে করছি, সে অনেক টাকা কর দিচ্ছে, বাস্তবে অনেক বেশি ফাঁকি দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ওই ব্যক্তি। ফলে এসব দিকে মনোযোগ বেশি দিতে হবে।

ওই বৈঠকে কর ফাঁকি ছাড়াও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তাদের উদ্দেশে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আপনারা দেশের কৃষকের দিকে নজর রাখবেন। আমি আমার এলাকার কৃষকের প্রকৃত অবস্থা জানি। প্রকৃত অবস্থা জানলে আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। এজন্য কৃষকের প্রকৃত অবস্থা জেনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

আইআরডির সূত্র জানায়, নানাভাবে বছরে ২০ থেকে ২১ হাজার কোটি টাকার আধুনিক কৃষি যন্ত্রাংশের বাজার রয়েছে। চাহিদা বাড়লেও কৃষি যন্ত্রপাতির বাজারের প্রায় ৭০ ভাগ এখনো আমদানিনির্ভর। এক দশক আগে অর্থাৎ ২০১১ সালে এই বাজার ছিল ১০ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ গড়ে না ওঠা, দক্ষ জনবলের অভাব, কর সুবিধা না থাকায় কৃষি যন্ত্রপাতির বাজার এখনো আমদানিনির্ভর। এ আমদানি পণ্যের শুল্ক সুবিধার দিকে অর্থমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন। এটি দেওয়া সম্ভব হলে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ব্যয়ও কমে আসবে। এটি সরাসরি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।

এছাড়া অর্থমন্ত্রী গুরুত্ব দিয়েছেন বৈদেশিক ঋণ, চুক্তি ও লেনদেনের ক্ষেত্রে নিগোসিয়েশন সক্ষমতা বাড়াতে। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তকর্তাদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে বলেছেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, অনেক বড় বড় চুক্তির ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা, ইংরেজি ভাষা (বিশেষ করে চুক্তিকারী দেশের) সঠিকভাবে না জানার কারণে এ ক্ষেত্রে ভালো ফল আসছে না। এজন্য তিনি এ নির্দেশনা দিয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ৯:১৮:১০ ● ১৩৯ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ