আবদুল খালেকের কাছে তাঁর ছেলে ইয়াসিনের প্রসঙ্গ এখন কেউ আর তোলেন না। সাত বছরের ইয়াসিন গত বছরের জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তাদের বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার তারাকান্দি গ্রামে। ছেলেটি স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। দুর্ঘটনার দিন বন্ধুদের সঙ্গে সড়কের পাশে খেলছিল শিশুটি। ধান বহনকারী একটি ভটভটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চাপা দেয় ইয়াসিনকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আহত ছেলেটিকে। কিন্তু এর আগেই তার মৃত্যু হয় বলে জানান চিকিৎসকেরা।
এ দুর্ঘটনার সময় ইয়াসিনের বাবা খালেক দেশের বাইরে ছিলেন। ছেলের মৃত্যুর ঘটনার পর দেশে ফিরে আসেন। গতকাল শুক্রবার কথা হয় ইয়াসিনের চাচা আবু তালেবের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা কেউ আর ছোলের কথা তুলি না। নাম শুনলেই ক্যাদতে (কাঁদতে) ক্যাদতে অজ্ঞান হয়্যা যায়। ওই নাম লেওয়া যায় না।’
ইয়াসিন ছিল তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুকে হারানো এমন অনেক পরিবার দুঃসহ কষ্ট নিয়ে আছে। প্রতিদিন দেশের সড়কে প্রাণ হারাচ্ছে শিশুরা। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন গত বছরের (২০২৩) সড়ক দুর্ঘটনার ওপর গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেখানে দেখা গেছে, দেশে ১ হাজার ১২৮ শিশু প্রাণ হারিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়; অর্থাৎ প্রতিদিন তিনটির বেশি শিশুর প্রাণ যাচ্ছে সড়কে।
বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, অ্যাম্বুলেন্স, অটোরিকশা কিংবা স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন নছিমন বা ভটভটির ধাক্কায় বা চাপায় এসব শিশু নিহত হয়েছে। দেখা গেছে, দেশের আঞ্চলিক সড়কগুলোয় গত বছর সবচেয়ে বেশি শিশু মারা গেছে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার সময়, বসতবাড়ির আশপাশের সড়কে খেলাধুলার সময় নিহতের ঘটনা বেশি ঘটেছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম এবং সংস্থার নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। রাজধানীতে প্রতিবেদনটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করবে সংগঠনটি।
ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, দেশে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬ হাজার ৯১১টি। এতে ৬ হাজার ৫২৪ জন নিহত হয়, আহত হয় ১১ হাজার ৪০৭ জন। মোট নিহতের ১৭ শতাংশের বেশি শিশু। গত বছর দেশে দুর্ঘটনার সংখ্যা এর আগের (২০২২) বছরের চেয়ে বাড়লেও কমেছে মৃত্যুর সংখ্যা। দুর্ঘটনায় শিশুমৃত্যুর সংখ্যাও আগের বছরের তুলনায় সামান্য কমেছে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের যানবাহন ও সড়ক—দুটির কোনোটিই শিশুবান্ধব নয়। অনেক স্থানে বাড়ি, স্কুলের একদম ধারেই সড়ক দেখা যায়। সড়ক থেকে নিরাপদ দূরত্বে মেনে এসব তৈরি হয় না। আবার অনেক স্থানে স্কুলের পাশে কোনো সড়ক প্রতিবন্ধকতা বা ওভারপাস থাকে না। তাই এক অপূরণীয় ক্ষতি আমাদের হচ্ছে দিনের পর দিন।’
গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশের বেশি শিশু মারা গেছে যাত্রী বা পণ্যবাহী বাস, ট্রাক ও প্রাইভেট কারের ধাক্কায়। এরপর আঞ্চলিক বা গ্রামীণ সড়কের যানবাহন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ইজিবাইকের ধাক্কায় শিশুর মৃত্যু হয়েছে। প্রায় ১৬ শতাংশ শিশুর প্রাণ গেছে বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায়। স্থানীয়ভাবে তৈরি নছিমন, ভটভটি বা মাহিন্দ্র কেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ শিশুর প্রাণ।
আমাদের যানবাহন ও সড়ক—দুটির কোনোটিই শিশুবান্ধব নয়। অনেক স্থানে বাড়ি, স্কুলের একদম ধারেই সড়ক দেখা যায়। সড়ক থেকে নিরাপদ দূরত্বে মেনে এসব তৈরি হয় না। আবার অনেক স্থানে স্কুলের পাশে কোনো সড়ক প্রতিবন্ধকতা বা ওভারপাস থাকে না। তাই এক অপূরণীয় ক্ষতি আমাদের হচ্ছে দিনের পর দিন
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান
বর্তমানে জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কের দৈর্ঘ্য ২২ হাজার কিলোমিটারের বেশি। গ্রামীণ সড়ক ৩ লাখ কিলোমিটারের বেশি।
দুর্ঘটনায় শিশু নিহত হওয়া সড়কের ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ৩৭ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়েছে আঞ্চলিক সড়কে। এরপরই আছে মহাসড়ক, গ্রামীণ সড়ক ও শহরের সড়ক।
রোড সেফটির বিশ্লেষণে দেখা যায়, গ্রামীণ সড়কে আগের বছরের (২০২২) চেয়ে গত বছরে শিশুমৃত্যু কমেছে। কিন্তু বেড়েছে আঞ্চলিক সড়কে। যেসব দুর্ঘটনার কবলে পড়ে শিশুদের মৃত্যু হয়, এর এক-তৃতীয়াংশের বেশি ঘটে দুপুরের দিকে। তবে সকাল ও বিকেলের দিকেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনায় নিহত শিশুদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৩ শতাংশেরই বয়স ৬ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। এরপরই আছে ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশু। নিহত শিশুদের মধ্যে ৩৭ শতাংশ এই বয়সী।
দুর্ঘটনায় শিশু নিহত হওয়া সড়কের ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ৩৭ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয়েছে আঞ্চলিক সড়কে। এরপরই আছে মহাসড়ক, গ্রামীণ সড়ক ও শহরের সড়ক।
‘সড়কে সুশাসন নেই’
অপরিকল্পিত সড়ক তৈরি, সেগুলোর যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাব, যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল—এসবকে সড়কে শিশুমৃত্যুর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
সড়ক পরিকল্পনা ও বিজ্ঞান মেনেই হচ্ছে বলেই দাবি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দুই বছর ধরেই সড়কে আইন মেনে চলার বিষয়টির দিকে বেশি জোর দিয়েছি। কিছু সুফলও পাচ্ছি। আইনটা তো সবার মানতে হবে। এক পক্ষকে মানলে চলবে না। সেটা নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে।’
সচেতনতার বিষয়টি থাকলেও ‘সড়কে সুশাসনের’ অভাবকেই শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণ বলে মনে করেন বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, সড়কটা নির্মাণ করেই একধরনের দায়সারার লক্ষণ প্রকট। এর কারণ এখানে অর্থের সংযোগ আছে। আছে রাজনৈতিক লাভালাভ। কিন্তু এটি মানুষের কতটুকু নিরাপত্তা দিচ্ছে, তার দিকে দৃষ্টি খুব কম।
আমরা দুই বছর ধরেই সড়কে আইন মেনে চলার বিষয়টির দিকে বেশি জোর দিয়েছি। কিছু সুফলও পাচ্ছি। আইনটা তো সবার মানতে হবে। এক পক্ষকে মানলে চলবে না। সেটা নিয়ে সচেতনতার অভাব আছে।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার