বঙ্গনিউজঃ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপে বাংলাদেশ। দিন দিন এই চাপ বাড়ছেই। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী অর্থবছরগুলোতে বিভিন্ন প্রকল্পে নেওয়া ঋণের বিপরীতে সুদ ও আসল পরিশোধের ধাক্কা সামলানো কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলমান ডলার সংকটের কারণে এ ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়িয়ে অর্থ ছাড় বাড়ানো না গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এ অবস্থায় বৈদেশিক অর্থপুষ্ট প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়াতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে সরকারও। শুধু এসব প্রকল্পের জন্য প্রথমবারের মতো মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে একটি কমিটি।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শাহরিয়ার কাদের সিদ্দিকীর কাছে ঋণ পরিশোধের চাপ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। বৃহস্পতিবার তিনি কোনো মন্তব্য না করে শুধু বলেন, রিপেমেন্ট নিয়ে তেমন কোনো আশঙ্কা নেই। তবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বিষয়ে জানতে ইআরডির ফাবা (ফরেন এইড বাজেট অ্যান্ড একাউন্টস) উইং এর অতিরিক্ত সচিব মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা জানিয়েছেন।
ইআরডি সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকারকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৫৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। যা টাকার অঙ্কে প্রায় ১৭ হাজার ২৪০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ১০৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলার, যা টাকার অঙ্কে প্রায় ১০ হাজার ১৪০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে তুলনামূলক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ৫১ কোটি ৪৪ লাখ ডলার বা প্রায় পাঁচ হাজার ৬৫৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সংস্থাটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে মোট যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে, এর মধ্যে আসল ছিল ৯২ কোটি ৬১ লাখ ডলার বা প্রায় ১০ হাজার ১৮৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এছাড়া সুদ ছিল ৬৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার বা প্রায় সাত হাজার ৫৬ কোটি ১২ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যে পরিমাণ ঋণ পরিশোধ করা হয়েছিল এর মধ্যে আসল ছিল ৭৭ কোটি ৮৩ লাখ ডলার বা প্রায় সাত হাজার ৪৯৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এছাড়া সুদ ছিল ২৭ কোটি ৫১ লাখ ডলার বা প্রায় দুই হাজার ৬৪৪ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার বলেন, জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যে হারে অর্থ ছাড় হয়েছে, পরিশোধ বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে। তবে যেভাবে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি বেড়েছে সেগুলো থেকে যদি ছাড় ঠিকমতো হয়, তাহলে হয়তো সমস্যা হবে না। তবে এজন্য প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে। কেননা প্রকল্পের বাস্তবায়ন না হলে অর্থ ছাড়ও হবে না। এ বিষয়টিতে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন। অর্থ ছাড় বাড়াতে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
সূত্র জানায়, কমছে নিট বৈদেশিক সহায়তা। চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে উন্নয়ন সহযোগীরা বৈদেশিক অর্থ ছাড় করেছে ৪০৬ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। অপরদিকে ১৫৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলার ঋণ পরিশোধ করায় নিট বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া গেছে ২৪৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে অর্থ ছাড় হয়েছিল ৩৭৮ কাটি পাঁচ লাখ ডলার। ওই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ১০৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। ফলে নিট বৈদেশিক সহায়তা এসেছিল ২৭৩ কোটি ১৬ লাখ ডলার। তুলনা করলে দেখা যায় চলতি অর্থবছরের ছয় মাসে বৈদেশিক অর্থ ছাড় বেশি হলেও নিট বৈদেশিক সহায়তা কম পাওয়া গেছে ২৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার।
সূত্র জানায়, পদ্মা সেতুসহ কয়েকটি মেগা প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ ও আংশিক উদ্বোধন হয়েছে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ এবং গ্রেস পিরিয়ড (রেয়াতকাল) শেষে হচ্ছে। এখন পরিশোধ করতে হবে সুদ ও আসল। গত অর্থবছরে যেখানে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করা হয়েছিল, সেখানে তা বেড়ে চলতি অর্থবছর দাঁড়াতে পারে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে। আগামী অর্থবছরে এ ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দাঁডাবে প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। এদিকে চলছে ডলার সংকট। আমদানিই যেখানে পুরোপুরি খুলে দেওয়া যাচ্ছে না, সেখানে ঋণ পরিশোধের এই চাপ অর্থনীতিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইআরডির প্রাক্কলন অনুসারে, ২০২৬ সালে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে নেওয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে। সংস্থাটির বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি হয় ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল। এই ঋণের পাঁচ বছরের রেয়াতকাল শেষ হয়েছে গত এপ্রিলে। ফলে চলতি অর্থবছর থেকে এ ঋণের আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ২০২৬ সালের পর মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ঋণের আসল পরিশোধও শুরু হবে। তখন বার্ষিক আসল পরিশোধ ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে যেতে পারে। এভাবে আরও অনেক বড় প্রকল্পের সুদ ও আসল পরিশোধের চাপ আসছে।