বঙ্গনিউজঃ জুন পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার আয় কমবে। এর বিপরীতে কঠোরভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার খরচও কিছুটা কমবে। তবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ ও সেবা খাতে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ বাড়ার চাপ রয়েছে। এসব মিলে ডলার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি থাকবে। ঘাটতির ডলার খরচ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে। ফলে রিজার্ভও থাকবে চাপে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক হিসাবেও ঘাটতি থাকবে। তবে দুই খাতেই ঘাটতি আগের চেয়ে কমবে।
দেশের সার্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের জুন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রা ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র মিলেছে। এছাড়া বুধবার ঘোষিত মুদ্রানীতি ও অন্যান্য প্রতিবেদনেও আছে এসব তথ্য।
জুন পর্যন্ত দেশের বৈদেশিক সম্পদ কমবে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। জুলাইয়ে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়ানোর। কিন্তু বৈশ্বিক ও দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে ওই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় বৈদেশিক সম্পদ বৃদ্ধির হার না বেড়ে বরং বর্তমানের চেয়ে কমে যাবে। এর প্রভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ বাড়বে। কারণ বৈদেশিক সম্পদ এখনো নিæমুখী। এমনকি আগের চেয়ে এ সম্পদ বেশি হারে কমছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নিট বৈদেশিক সম্পদ (রিজার্ভ, স্বর্ণ, রুপা ও অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা) ছিল ৩ লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণ। গত নভেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে নিট বৈদেশিক সম্পদ কমেছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমেছে ৫২ হাজার কোটি টাকার। অর্থাৎ বৈদেশিক সম্পদ আগের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি কমেছে। মূলত ডলারসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা আয় কমা ও রিজার্ভ থেকে খরচ করার কারণে এ সম্পদ কমছে।
মুদ্রানীতিতে দেওয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগাম পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, জুন পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাতগুলোর মধ্যে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কমবে। জুলাইয়ে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১০ শতাংশ, এখন তা কমিয়ে করা হয়েছে ৪ শতাংশ। একই সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে যাবে। এছাড়া ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও ভূ-অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) কমার ক্ষেত্রে প্রভাব রাখছে। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে এফডিআই এসেছিল ৭৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ৬৯ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে বিনিয়োগ কমেছে ১১ শতাংশ। অন্যদিকে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ তুলে নেওয়া হয়েছিল ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। ওই সময়ে এ ধরনের বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে ১৩১ শতাংশ। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের প্রবণতাও কমেছে। এসব কারণে ডলারের প্রবাহ কমবে।
ডলারের ব্যয়ের প্রধান খাত হচ্ছে আমদানি ব্যয়। ডলার সংকট ও রিজার্ভ সাশ্রয়ে এতে আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে আমদানি কমেছিল ১৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে কমেছে ২১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি বেড়েছিল সাড়ে ৪ শতাংশ। ২০২২ সালের নভেম্বরে আমদানি কমেছিল সাড়ে ৩ শতাংশ। নভেম্বরে কমেছে সাড়ে ২২ শতাংশ। জুলাইয়ে চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ৮ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। ডলার সংকটের কারণে জুনের মধ্যে এ ব্যয় না বাড়িয়ে বরং আগের চেয়ে ৭ শতাংশ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এসব কারণে আমদানিতে ডলারের খরচ কমবে।
তবে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমদানি খাতের ট্রেড ক্রেডিট ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে বেশি মাত্রায়। গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে ট্রেড ক্রেডিট ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাবদ নিট পরিশোধ করা হয়েছিল ২২ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছে প্রায় ৬৫০ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় ৩০ গুণ। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণও চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হবে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। নতুন ঋণ কম আসা এবং আগের ঋণ পরিশোধের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপের সৃষ্টি করেছে। এর বাইরে বিদেশ ভ্রমণ, চিকিৎসা, পড়াশোনা ও অন্যান্য সেবা খাতের ব্যয় এতদিন নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এখন এসব খাতে চাহিদা বেড়েছে। ফলে আগের চাহিদার সঙ্গে আরও নতুন চাহিদা যোগ হবে। ফলে এসব খাতেও ব্যয় বাড়বে। যে কারণে ডলারের খরচ বেড়ে যাবে। সব মিলে চাহিদা অনুযায়ী ডলার না থাকার কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা শিগগিরই কাটছে না।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মইনুল ইসলাম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, গৃহীত পদক্ষেপের ফলে চট করেই সংকটের সমাধান হবে না। সংকট আরও কিছুটা সময় থাকবে। দক্ষতার সঙ্গে সঠিক পদক্ষেপ নিলে ধীরে ধীরে সংকট কাটবে। এজন্য টাকা পাচার ও হুন্ডি বন্ধ করতে হবে। খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানতে হবে। পণ্যমূল্যের সিন্ডিকেট বন্ধ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করায় এবং রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি কমতে শুরু করেছে। গত অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি হয়েছিল ১ হাজার ৭১৬ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে ঘাটতির প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ হাজার ২০ কোটি ডলার।
ডলারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় প্রথমেই ঘাটতি তৈরি হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে রেকর্ড ঘাটতি হয়েছিল ১ হাজার ৮২০ কোটি ডলার। গত অর্থবছরে এ ঘাটতি কমে দাঁড়ায় ২৬৭ কোটি ডলারে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৩ কোটি ডলার। বৈদেশিক মুদ্রার সার্বিক স্থিতিতে গত অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ২০৮ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬০ কোটি ডলার। অর্থাৎ ঘাটতি কমছে। এ ঘাটতির কারণেই কমছে রিজার্ভ।
গত জুলাইয়ের প্রাক্কলন অনুযায়ী আগামী জুনের দেশের গ্রস রিজার্ভ ৩ হাজার ১৫০ কোটি ডলার রাখার কথা; কিন্তু এটি সম্ভব হবে না। সম্প্রতি তা কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ রিজার্ভ ধারণের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে ৮ শতাংশ। গ্রস রিজার্ভের চেয়ে বর্তমানে নিট রিজার্ভ প্রায় ৫৫০ কোটি ডলার কম। এ হিসাবে নিট রিজার্ভ রাখার কথা ২ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার। এদিকে আইএমএফ জুনে ২ হাজার ১১ কোটি ডলারের নিট রিজার্ভ রাখার লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে।