‘
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’ স্লোগান শুধু কানেই বাজে। বাস্তবতার চিত্র ভিন্ন কথা বলে। শিশুশ্রম প্রতিরোধ সম্ভব হয়নি। দারিদ্রতার কারণে যেন শিশু-কিশোর অপরাধ ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের নেই মানসিক বিকাশের সুষ্ঠু পরিবেশ। সুষ্ঠু মানসিক বিকাশের ব্যাঘাতের কারণে বলা যায় অপরাধের পরিমাণ বেড়ে চলেছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, শিশুরাই সবচেয়ে নির্মল, সবচেয়ে মানবিক ও সৃজনশীল। তাদের মেধা ও সৃজনশীলতা বিকাশে তাই প্রয়োজন সঠিক, সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। সাম্প্রতিক পত্রিকা, নিউজ চ্যানেলে গুলোতে চোখ পড়লেই দেখা যাচ্ছে ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, হত্যাকাণ্ডের মত গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে শিশু-কিশোর। ২০১৩ সালে দেখেছি বাবা-মাকে হত্যা করার ঘটনার সাথে জড়িত ঐশীকে। অনেক সময় তুচ্ছ বিষয় কেন্দ্র করে বন্ধুবান্ধব এর মাঝে মারামারি, বিবাদ, হত্যাকাণ্ডের সৃষ্টি হচ্ছে। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করছে অল্প বয়সে।
সাম্প্রতিক টিকটক, লাইকি, ইউটিউব, ফেইসবুক অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খ্যাতি পাওয়ার লোভে কিশোর গ্যাং তৈরি করে ফেলছে অল্পবয়সী শিশু-কিশোর’রা। সেখান থেকে সংগঠিত হচ্ছে নানান অপরাধ। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্নর কারণে হয়ে উঠেছে।সভ্যতার বিকাশে উন্নত হচ্ছে দেশ, উন্নত হচ্ছে প্রযুক্তি। প্রযুক্তির অপব্যবহারের ফলে অপরাধের পরিমাণ বেড়ে চলছে চক্রবৃদ্ধি হারে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে জন্মগ্রহণের পর থেকেই মোবাইল, ইন্টারনেট, গেমস, ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ অত্যন্ত সহজলভ্য। কিন্তু, যে কোনো কিছুর বিকাশ হতে হয় সমাজের চলমান সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে। বর্তমানে শিশু কিশোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধু-বান্ধব নির্বাচন করে। বেশিরভাগ সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করেই কাটিয়ে দিচ্ছে। সুষ্ঠু বিকাশের মাধ্যম ব্যাহত হচ্ছে।এখনকার শিশু-কিশোর ঘরকুনো থাকতে পছন্দ করে।
তারা ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার,গোল্লাছুট ইত্যাদি খেলাধুলা করে না। এর কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণে মাঠ নেই শহরাঞ্চলে। গুটিকয়েক থাকলেও সেখানে ইট, বালু, সিমেন্ট রাখা হয়েছে।শিশু-কিশোরের লেখাপড়া, আচরণ, খেলাধুলা, কোন বিষয়ের প্রতি শিশুর মনোযোগ বেশি, শিশুর খাদ্যাভ্যাস, পোশাক নির্বাচন ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি অভিভাবক কতটা সচেতন? এই সচেতনতার প্রতি দৃষ্টি না দিয়েই আমরা শিশুদের নানাভাবে প্রলুব্ধ করি। যেমন হয়তো বলি, পরীক্ষায় প্রথম হলে তাকে দামি উপহার দেওয়া হবে। কিন্তু, এমন উপহার না দিয়ে যদি শিশুর স্বাভাবিক কৌতূহল বা আগ্রহের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।
সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের কারণে ঘরবন্দী সকলেই। পড়ালেখা, অর্থনীতি, ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ যেন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইন্টারনেটে সময় কাটাচ্ছেন দিনের অধিকাংশ সময়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় তাদের পড়ালেখার চাপটা নেই একেবারে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস এর মাধ্যমে পাঠদান করা হলেও কতটুকু কার্যকর তা প্রশ্ন রয়ে যায়?
সময়টা অন্যভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।বিভিন্ন অনলাইন ভিত্তিক কোর্স সমূহের মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ করে তোলা। নিজের প্রতিভা বিকাশ করা। বিভিন্ন বইপুস্তক পড়ে জ্ঞানার্জন করা।
কিন্তু, এসবের দিকে না গিয়ে তারা টিকটক, লাইকিতে ভিডিও তৈরির মাধ্যমে পরিচিতি বাড়ানোর চেষ্টায় জড়িয়ে পড়ছে নানান অপকর্মে।অল্পবয়সেই খ্যাতি পাওয়ার একটা আকাঙ্ক্ষা দেখা দিয়েছে। পরিবারের সদস্যদের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাদের ভাল দিকগুলো তুলে ধরতে হবে। দক্ষতা বাড়াতে হবে, দেশের কল্যাণে কাজে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে হবে। সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে।ঘুড়ি ওড়ানো, লাটিম, মার্বেল, কানামাছি, নৌকাবাইচ, সাঁতার, গোল্লাছুট। শিশুর মানসিক বিকাশ, মানবিক সংস্কৃতি চর্চার জন্য ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন এসব খেলা এবং খেলার মাঠ। প্রযুক্তির পাশাপাশি এসব খেলাধুলার চর্চার মধ্য দিয়ে শিশু হয়ে উঠতে পারে মানবিক চেতনার ধারক ও বাহক।