বর্তমান যুগে তথ্যপ্রযুক্তির সংশ্লিষ্টতা ছাড়া জীবনে গতিময়তা আনা সম্ভব নয়। ইন্টারনেট ব্যবহারের যেমন ভালো দিক আছে তেমনি খারাপ দিকও আছে। তবে এর নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে সজাগ থাকা খুবই জরুরি। ইন্টারনেট মানবসভ্যতার একটি বিস্ময়কর অবদান। বর্তমান প্রজন্ম অতি দ্রুত এই প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হচ্ছে।
এক যুগ আগেও শিশু কিশোরদের খেলার সাথি ছিল পাড়া প্রতিবেশী শিশু-কিশোর, নানা ধরনের মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল। হরেক রকমের খেলা খেলে পার করত নিজেদের শৈশব-কৈশোরকাল।
বর্তমানে সময়ে শিশুদের খেলার সঙ্গী এখন স্মার্টফোন। ভিডিও গেমস ও কার্টুন দেখাতে ব্যস্ত তারা। কান্না থামাতে তাদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া স্মার্টফোন। ফলে শিশু একটা সময় অনলাইনে আসক্ত হয়ে যায় আর পড়তে চায় না। পড়লেও পড়া মনে থাকে না। তার মন মানসিকতা সব সময় অনলাইনের দিকে আসক্ত থাকে।
শিশুকাল হলো মানুষের জ্ঞান অর্জনের প্রথম ধাপ। এখান থেকে তার হাতে খড়ি শুরু হবে। তা না হলে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতা হারিয়ে যাবে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আর অনলাইনে আসক্তি হয়ে শিশু কিশোররা ভবিষ্যতে মেধা শূন্যে জাতির পথে অগ্রসর হচ্ছে।
বর্তমান তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেটের মাধ্যমে অবাধ তথ্যসম্ভারে বিচরণের মধ্য দিয়ে নিজেদের চিন্তা, জ্ঞানের পরিধি ও সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটাতে পারছে ঠিক। তবে এর ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন না থাকায় নানা ধরনের বিপদে হাবুডুবু খেতে হচ্ছে।
শিশু-কিশোররা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এই অনলাইনে জগতে আসক্ত হয়ে কোন সময় দিন গিয়ে রাত আসে রাত গিয়ে দিন আসে কোনো খবর থাকে না। খাবার-দাবারেও অনিয়ম তৈরি হয়। এতে স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর একটি বড় অংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ইন্টারনেটে নিরাপত্তা নিয়ে শিশুরা কী ভাবে, তাদের পরিস্থিতি কী, এসব জানতে ইউনিসেফ সারা দেশে একটি জরিপ চালায়। ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী ১১ হাজার ৮২১ ছেলেমেয়ে জরিপে অংশ নেয়।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের ওই জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের ৮১ দশমিক ২ শতাংশ শিশু-কিশোর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন সময় কাটায়। এদের ৯০ শতাংশই মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক ১২ কোটি ৬১ লাখের বেশি। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত গ্রাহক বেড়েছে ২০ লাখ। শিশু-কিশোররা ইন্টারনেটের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারের সঙ্গে সাইবার অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে বা এর শিকার হচ্ছে।
বেসরকারি এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৬০ শতাংশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে। ছদ্মবেশে বখাটেপনা, ইভটিজিং করা ইত্যাদি থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমে অহরহই হচ্ছে হ্যাকিং, ঘটছে ব্ল্যাকমেলের মতো ঘটনাও। বেসরকারি জরিপে দেখা যায়, প্রতি ২০ সেকেন্ডে এই ধরনের একটি অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে ব্যক্তি থেকে শুরু করে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে।
ইন্টারনেটের অপব্যবহার রোধ করতে হলে সতর্ক হতে হবে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। নিরাপদ ইন্টারনেটের ব্যবহারবিধি পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করা প্রয়োজন। যে কোনো মূল্যে শিশু কিশোরদের নিরাপদ শৈশব-কৈশোরকাল নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা নিশ্চিত তুলতে পারব তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, অভিভাবককে দেখতে হবে কেন তার সন্তান অনলাইনে বা অনলাইন গেমে সময় কাটানোতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে? শুধু অনলাইন গেম খেলতে কিংবা অনলাইনে থাকতে নিষেধ করলেই হবে না, বিকল্প কোনো খেলাধুলার ব্যবস্থা করার বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। তাছাড়া সন্তানের সামনে অভিভাবকদের স্মার্টফোনে মগ্ন থাকা, খাবার টেবিলে স্মার্টফোন দেখার অভ্যাসেও পরিবর্তন আনতে হবে।