স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদায় আওয়ামী লীগ

Home Page » ফিচার » স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদায় আওয়ামী লীগ
শুক্রবার ● ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩


 বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

একটি দেশকে স্বাধীনতা পাইয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল হিসেবে একচ্ছত্র দাবিদার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। দলটি স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যেকটি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং দলটির নেতৃত্বেই স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। দলটির নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্যারিশমেটিক দক্ষতায় পুরো বাঙালি জাতিকে একত্র করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং মাত্র ৯ মাসের ব্যবধানে কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা অর্জন করে। কাজেই বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ একে অন্যের পরিপূরক। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন দল হিসেবে গণমানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দলটির দায়িত্বশীল ভূমিকার ইতিহাস কারো অজানা নয়। আওয়ামী লীগের ইতিহাস ৭৪ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস। এই সময়টায় আওয়ামী লীগকে নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে জনমানুষের পাশে থাকতে হয়েছে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন দলটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাঙালির অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে দলটি।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানিরা প্রথমেই আঘাত হানে বাঙালির ভাষার ওপর। ভাষা আন্দোলনে তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জোরালো ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি সামরিক শাসক সে সময় বঙ্গবন্ধুকে জেলে বন্দি করে রেখেছিল। ভাষা আন্দোলনকে জোরালো রূপ দিতে তিনি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তী সময় ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। শুরুতে দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন শেখ মুজিবুর রহমান। পরে ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই বঙ্গবন্ধু দলটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি তার দক্ষতায় দলটিকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলেন এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে আওয়ামী লীগ। মন্ত্রিসভার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও দলের প্রতি অন্তঃপ্রাণের কারণে বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন, যা সমসাময়িক সময়ে অত্যন্ত বিরল ঘটনা।

আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তথা সামরিক সরকারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন জোরদার করে আওয়ামী লীগ। সাধারণ জনতাও দীর্ঘদিনের নিষ্পেষণ, বঞ্চনা, বৈষম্য থেকে মুক্তির আশায় আওয়ামী লীগের সমর্থনে রাস্তায় নামে এবং আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। পরবর্তী সময়ে ৬২ ও ৬৪-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৪-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ, ৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুক্তিপাগল প্রতিটি বাঙালিকে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য তৈরি করে তোলেন। তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সফর করে আওয়ামী লীগের পক্ষে জনমত তৈরি করেন এবং জনসাধারণকে স্বাধীনতার পক্ষে উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। যার প্রমাণ মিলে ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে, পূর্ব বাংলার জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয় এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। কিন্তু এ ফলাফলকে সামরিক সরকার মেনে নেয়নি, তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে টালবাহানা শুরু করে। দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও এর কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালিরা, দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে জনতা। পরবর্তী সময়ের ইতিহাস সবারই জানা, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হল। বাংলাদেশ নামকরণ করা হলো। ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণ প্রদান করলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। ২৫ মার্চ কালরাতে যুদ্ধের কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাঙালিদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার শুরু করেন। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু অফিশিয়ালি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যুদ্ধে অংশ নেয়।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠনে ব্যাপক উদ্যোগ হাতে নেয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী, পরাজিত শত্রুরা বসে ছিল না। তারা স্বাধীনতার পর দেশের সরকারকে নানাভাবে বিতর্কিত করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। কিন্তু সরকার সব প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে দেশকে পুনর্গঠনের ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করে, তখনই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের পর বাঙালি জাতি কার্যত পিছিয়ে পড়ে। হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারীদের এবং সরাসরি হত্যাকাণ্ডে নিয়োজিতদের পরে দায়িত্ব পালনকারী স্বৈরশাসকরা পুরস্কারে ভূষিত করে, যা জাতির জন্য ছিল চরম লজ্জার।

দেশের প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে। আওয়ামী লীগের উদ্যোগেই মাতৃভাষা বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার আনুষ্ঠানিক মর্যাদা লাভ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ঘোষিত হয় জাতীয় ছুটির দিন ‘শহীদ দিবস’। আওয়ামী লীগ সরকারের উদ্যোগেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ প্রায় সম্পন্ন হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু, টঙ্গীর ইজতেমা ময়দানের জায়গা বরাদ্দ দেন বঙ্গবন্ধু। কাজেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন ও সমৃদ্ধিতে আওয়ামী লীগের অসামান্য অবদান।

৭৫-এর পটপরিবর্তনের পরে সামরিক সরকাররা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার করেই ক্ষান্ত হননি, বঙ্গবন্ধুর বিচারকাজকে চিরতরে রুদ্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। ভাবা যায়, একটি দেশের জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যার বিচার হবে না মর্মে আইন পাস হয় জাতীয় সংসদে। এমন শ্বাপৎসংকুল পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে, দেশে ফিরলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। দলের হাল ধরলেন তিনি। বহুধাবিভত্ত আওয়ামী লীগকে দলীয় সভাপতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তার দূরদর্শী বিচক্ষণ নেতৃত্বে তিনি দেশে ফেরত আসার পর বারবার দলের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

দেশে ফেরত আসার পর আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার পাশাপাশি রাজপথে থেকে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এসব আন্দোলন-সংগ্রামে নেতাকর্মীদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ছিল, অনেকেই আত্মাহুতি দিয়েছেন। নানা চড়াই-উতরাইয়ের পর ১৯৯৬ সালে দীর্ঘ সময় পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। পরবর্তীকালে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জনগণের বিপুল ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ভোটাররা ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল এবং দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকার নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং অদ্যাবধি রাষ্ট্রের উন্নয়নে, স্থিতিশীলতায় ব্যাপক ভূমিকা রাখছে দলটি। আন্তর্জাতিক পরিসরেও সরকারের ব্যাপক অর্জন রয়েছে, বৈশ্বিক বিশ্লেষণে বাংলাদেশ অসংখ্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশি মডেল অনুকরণ করছে বিদেশি বন্ধুরা। উল্লেখযোগ্য মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার, এর মধ্যে কিছুর কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং এখনো কিছু কাজ চলমান রয়েছে।

বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সফলতা ঈর্ষণীয়। মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, ১০০ সেতু উদ্বোধন একযোগে, আঞ্চলিক সড়কগুলো চার লেন করা হয়েছে। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে পদদলিত করে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে, সরকারের স্থিতি এবং উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে, নতুন করে উদ্যোক্তা হচ্ছে বাংলাদেশে, এরা জাতীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এসবের পেছনে আওয়ামী লীগ সরকারের অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর শিক্ষায় বাংলাদেশের অগ্রগতি অত্যন্ত অর্থবহ। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এখানকার দরিদ্র নারীদের পরিবর্তন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে আমি মুগ্ধ।’ নারীরা কিন্তু আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী। অসংখ্য নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে এবং তাদের উৎপাদিত সেক্টরে অসংখ্য নারীর কর্মসংস্থান হচ্ছে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেশে প্রভূত উন্নতি হচ্ছে, যা খুবই ইতিবাচক এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে সমসাময়িক অনেক রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সুসংহত। ইত্যবসরে বাংলাদেশের সরকার প্রধান রূপকল্প ২০৪১-এর রূপরেখা প্রণয়ন করেছেন। বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে রূপরেখা অনুযায়ী বাংলাদেশ যথাসময়ে উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বেশ কিছু ইস্যুর সমাধান নিশ্চিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম সমুদ্র বিজয়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে, সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে।

লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৩:৫২:২৯ ● ২৬৯ বার পঠিত




পাঠকের মন্তব্য

(মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নয়।)

আর্কাইভ