দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ লক্ষ্যে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা, সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি আরও কঠোর করা, সব ধরনের সুদহার বাড়ানো, বাজারে টাকার প্রবাহ কমানো, সরকারকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায় ঋণের জোগান দেওয়া বন্ধ করা, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় কমিয়ে উৎপাদনমুখী খাতে ঋণের জোগান বাড়ানো হয়েছে।
এজন্য সাময়িকভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কিছুটা কমলেও মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে আসবে। যেহেতু উচ্চ মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে।
বুধবার প্রকাশিত দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে হালনাগাদ প্রতিবেদন ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ত্রৈমাসিক’ শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তিন মাস পরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। গত জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে হালনাগাদ তথ্যও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রাম ও শহর দুই ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি বাড়ছে। গ্রামীণ এলাকায় উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে এর আঘাত বেশি আসছে।
নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমার কারণে তারা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে পড়ছে। এছাড়াও উচ্চ মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির প্রায় সব সূচকগুলোকেই আঘাত করছে। এ কারণে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণকেই এখন সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার থেকে এখন যেসব নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে তার প্রায় সবই মূল্যস্ফীতির হারকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য থেকে। এ কারণে অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে এসেছে। আগামীতে এ হার আরও কমবে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশা করছে।
এতে আরও বলা হয়, দেশের অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চাপে যেমন কিছু খাতে অস্থিতিশীলতা রয়েছে, তেমনি ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাও রয়েছে। এর মধ্যেই চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সামগ্রিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক গতিপথ অনেকাংশে সামনের দিকে এগোচ্ছে। এর মধ্যে কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধি ও শিল্প খাত উৎপাদনের দিক থেকে আগের অবস্থায় ফেরার দিকে এগোচ্ছে। এছাড়া দেশের ভেতরে মানুষের চাহিদাও বেড়েছে। এদিকে পরিষেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল মাঝারি মানের। প্রাথমিকভাবে ব্যবসা, বাণিজ্য এবং ভোক্তা অর্থায়নে ঋণ প্রবাহ হ্রাসের কারণে এসব খাতে কিছু নেতিবাচক পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে এসব খাতে লাগাম টানা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ডবল ডিজিটে রয়ে যাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মূল্যস্ফীতির বড় অংশই আসছে খাদ্য ও জ্বালানি খাত থেকে।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের পরিস্থিতিতে উন্নতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের চেয়ে আয় বেড়েছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার চলতি হিসাবে ঘাটতি কমে এখন উদ্বৃত্ত হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিক ভারসম্যের আর্থিক হিসাবে এখনো উচ্চতর ঘাটতি রয়েছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখনো নিম্নমুখী হচ্ছে।
এতে বলা হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হারের একটি লক্ষ্যভিত্তিক নীতি বাস্তবায়ন করছে। ফলে সব খাতেই সুদহার বাড়ছে। নীতি সুদহারও বাড়ানো হয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতিতে চাপ কিছুটা কমতে পারে। কারণ নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারের প্রবণতা কমবে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজারে টাকার প্রবাহ কমবে।
সূত্র জানায়, বাস্তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ধারের প্রবণতা কমেনি। বরং বেড়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সামগ্রিক রাজস্ব আহরণ বাড়ানো গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুল্কভিত্তিক পণ্য আমদানি কম হওয়ায় রাজস্ব আহরণ কমছে। তবে সরকারি ব্যয় কমানোর ফলে রাজস্ব আয় কমলেও সরকারের কেন্দ্রীয় হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষে ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকার বাজেট উদ্বৃত্ত রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামীতে অর্থনৈতিকভাবে একটি টেকসই পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা রয়েছে। যা কৃষি ও শিল্প খাতের মাধ্যমে সম্ভব বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
দেশের ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, এ খাতে মিশ্র প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ঋণপ্রবাহ কমেছে। কিন্তু আমানত প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে। বিধিবদ্ধ আমানত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ব্যর্থ হচ্ছে। অতিরিক্ত তারল্য হ্রাস পাচ্ছে।