স্কুলজীবনে ‘পুরস্কার’ সিনেমাটি মনে দাগ কেটেছিল, যেখানে রতন আর বাদশা নামের দুই কিশোরের জীবনকে কেন্দ্র করে সিনেমাটি নির্মিত হয়, যারা কিনা ছিল কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে। পরে আরও কয়েকবার সিনেমাটি দেখেছি আর কেঁদেছি। তখনই কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে কেন শিশু-কিশোর যায় আর তাদের জীবন সেখানে কেমন কাটে তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ ছিল না। পত্রপত্রিকায় শিশু কিশোর সংশোধন কেন্দ্র নিয়ে বিভিন্ন বেদনাদায়ক ঘটনা বিষয়টি সম্পর্কে আরও কৌতূহলী করেছে।
জাতীয় কিশোর উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান নামে গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে রয়েছে জাতীয় কিশোর অপরাধ সংশোধন ইনস্টিটিউট, যেখানে কিশোর আদালত, কিশোর হাজত বা রিমান্ড হোম ও সংশোধনী কার্যক্রম রয়েছে একসঙ্গে।
১৯৭৮ সাল থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয় এবং বর্তমানে এর তিনটি কেন্দ্র রয়েছে; যার দুটি রয়েছে গাজীপুরে, আরেকটি রয়েছে যশোরে। গাজীপুরে একটি মেয়েদের ও একটি ছেলেদের জন্য এবং যশোরের কেন্দ্রটি শুধু ছেলেদের জন্য। অন্তত তাত্ত্বিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হলো শাস্তির পরিবর্তে সংশোধনের ওপর জোর দিয়ে আইন ভঙ্গকারী শিশু-কিশোরদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা।
শিশু-কিশোর দ্বারা সংঘটিত সমাজের নিয়ম-নীতি বিরুদ্ধ কাজ করাকে বলে কিশোর অপরাধ। কিশোর বয়সে ছেলেমেয়েদের জীবন নিয়ে থাকে ব্যাপক কৌতূহল। প্রতিকূল পরিবেশে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে গিয়ে বা সাময়িকভাবে হতাশা থেকে মুক্তি পেতে ধীরে ধীরে অন্ধকারের পথে পা বাড়ায় শিশু-কিশোররা। আবার অনেক অপরাধ বিশ্লেষক মনে করেন, বর্তমান বিশ্বের শিল্পায়ন ও নগরায়ণের ফলে একক পরিবার কাঠামো, শহর ও বস্তির দমবন্ধকর পরিবেশ, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, অপসংস্কৃতির বাঁধভাঙা জোয়ার ইত্যাদি কারণেও অনেক সময় শিশু-কিশোররা অপরাধপ্রবণ হয়ে পড়ে। কিশোরদের আইন ভাঙার প্রবণতা গ্রাম অপেক্ষা শহরেই বেশি দেখা যায়। আর এদের মধ্যে সাধারণত যেসব অপরাধ দেখা যায় তা হলো– মাদকদ্রব্য গ্রহণ, খেলার মাঠ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মারামারি ও বিশৃঙ্খলা, পরীক্ষায় নকল করা, টিকিট কালোবাজারি করা, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা, রাস্তাঘাটে ছিনতাই, জুয়া খেলা, চুরি ইত্যাদি।
সাধারণত সাত থেকে ষোল বছরের কিশোর-কিশোরী দ্বারা সংঘটিত অপরাধ কিশোর অপরাধ হিসেবে ধরা হয়; তবে বিভিন্ন দেশে এই বয়সের পার্থক্য বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ১৬ বছরের নিচে কেউ অপরাধ করলে সেটাকে কিশোর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। শিশু-কিশোরদের আইন ভঙ্গকারী কাজকে কম গুরুত্ব দিয়ে বরং এর পেছনের কারণকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়। এই কিশোর-কিশোরীদের শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের ব্যবস্থা করা এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ। আর তার জন্যই এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয় সংশোধন কেন্দ্র বা সংশোধনাগার।
বাংলাদেশের যেসব কিশোর উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেসবের অবস্থা খুবই নাজুক বলে গণমাধ্যমের অনেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। সেগুলোতে যতজনের ব্যবস্থা আছে, দেখা গেছে যে তার বিপরীতে অনেক বেশি শিশু-কিশোর সেখানে রয়েছে। ফলে প্রায়ই এগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দেওয়া হয় না, আর পরিমাণেও কম দেওয়া হয় বলেও অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। আবার অসুখ-বিসুখ হলে তাদের নিজস্ব ডাক্তার না থাকায় নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয় কিশোর-কিশোরীদের। প্রায়ই তাদের বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ ও ত্বকের সমস্যা লেগেই থাকে বলে আমরা পত্রিকা মারফত জানতে পারি। এসব ছেলেমেয়েকে সংশোধনাগারে রাখাই হয় তাদের সঠিকভাবে যত্ন- শিক্ষা দিয়ে নিজেদের ভুলগুলো শোধরানোর ব্যবস্থা করা এবং প্রকৃত মানুষ হওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু এখানকার পরিবেশ যদি মানবিক না হয়, তবে সংশোধন কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য অর্জিত হয় না। আমাদের দেশের আর্থিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এই শিশু-কিশোর সংশোধন কেন্দ্রগুলোর সুযোগ-সুবিধাও বৃদ্ধি করতে হবে।
দেশের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সমাজের সবাইকে বিশেষ করে অভিভাবক এবং শিক্ষকমণ্ডলীকে এগিয়ে আসতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে সবাইকে যথাযথ সচেতন ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে এই কিশোরদের একটি সুন্দর পরিবেশ দেওয়ার জন্য। তাদের আবেগ ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের জন্য পিতামাতাকেই যত্নবান হতে হবে অনেক বেশি। তাদের বুঝতে হবে ছেলেমেয়েরা তাদের থেকে কী আশা করে। তারা যেন তাদের পরিবারের সদস্যদের আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত না হয়। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সন্তানের ভালোলাগা-মন্দলাগার মূল্য দিতে হবে, যাতে তাদের মনের কথা গুমরে না মরে। গঠনমূলক পারিবারিক আলোচনা শিশু কিশোরদের মানবিক ও নৈতিক চরিত্র গঠনে সহায়ক।
গণমাধ্যমগুলোকে শিশুদের মানসিক বিকাশের উপযোগী অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে দুরন্ত শিশু-কিশোরদের জন্য আরও বিনোদনের সুযোগ তৈরি হওয়া উচিত। দেশে অধিক সংখ্যক সংশোধনাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেন আইনের পাশাপাশি শিশু-কিশোররা অনুকূল পরিবেশে সঠিক শিক্ষা পেয়ে নিজেদের সংশোধন করে সমাজে একটা বড় জায়গা করে নিতে পারে।
কিশোর বয়স ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত গড়ার সময়। তাই যদি এই সময়টাতে আমরা তাদের উপযুক্ত পরিবেশ না দিতে পারি বেড়ে ওঠার জন্য, তবে তাদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। আর সেই সঙ্গে যদি সেসব কারণকে আমরা দূরে রাখতে না পারি যে কারণগুলোর জন্য তারা বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে তবে তাদের সঠিক বিকাশের পথ সুগম হবে না। আর এজন্য আমাদের ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশকে তাদের অনুকূলে করতে হবে, পাশাপাশি তাদের পারিবারিক জীবন আনন্দময় ও উপযুক্ত শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়তে হবে। তবেই আমরা পারবো আমাদের দেশের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি করতে। তাই সরকারের পাশাপাশি সবাইকে যে যার অবস্থান থেকে শিশু-কিশোরদের মানসিক মূল্যবোধের দিকে নজর দিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিশু-কিশোরদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া শুধু তাদের পরিবারের ক্ষতি নয়, বরং এটি পুরো জাতির একটি সার্বিক ক্ষতি। একটি শিশুকে সংশোধনাগারে পাঠানোর অর্থ হচ্ছে তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করা আর পরিবারবিহীন পথশিশুদের সংশোধনাগারে পাঠানোর অর্থ হচ্ছে আমাদের সামাজিক সামষ্টিক ব্যর্থতা। শিশু-কিশোরদের শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বয়স বাড়ানোর মতো হঠকারী পদক্ষেপ না নিয়ে আমাদের শিশু-কিশোরদের প্রতি মানবিক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
লেখক: রন্ধনশিল্পী ও ফ্রিল্যান্সার