বঙ্গনিউজঃ চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থেকে ৩৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা কাটছাঁট করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তবে চূড়ান্ত পর্যায়ে কিছুটা কমবেশি হতে পারে। এতে ভর্তুকি ও সুদ পরিশোধসহ বাজেট বাস্তবায়ন চাপের মুখে পড়বে-এমন আশঙ্কা অর্থ বিভাগের। বৈশ্বিক সংকট ও জাতীয় নির্বাচন ঘিরে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা সার্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ার কারণেই মূলত রাজস্ব আয় কাটছাঁট করা হচ্ছে। যদিও এর আগের অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ে কাটছাঁট করা হয়নি।
জানা গেছে, আমদানির জন্য ডলার মিলছে না। এই সংকটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের কাঁচামালসহ অন্য পণ্য আমদানি। একইভাবে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এরই মধ্যে কমানো হয়েছে ভোজ্যতেল ও চিনির শুল্ক। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এ দুটি পণ্য রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অপরদিকে কৃচ্ছ সাধনের কারণে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড়ে অনেকটা কড়াকড়ি আরোপ আছে। রিজার্ভ ধরে রাখতে বন্ধ আছে বিলাসী পণ্যের আমদানিও।
সূত্রমতে, চলতি বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৫ লাখ ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। কাটছাঁটের প্রস্তাবে রাজস্ব আয়ের সংশোধিত আকার নির্ধারণ করা হয় ৪ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। বৃহস্পতিবার আর্থিক মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হার কো-অর্ডিনেশন্স কাউন্সিল বৈঠকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। এরপরও যে সংশোধন করা হচ্ছে সেটি কতটুকু আদায় সম্ভব তা দেখার বিষয়। বর্তমানে বিনিয়োগ হচ্ছে না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। নির্বাচনের পর কী দাঁড়ায়, সেটি বলা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে।
সূত্রমতে, জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এই চার মাসে শুধু রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৯৫ কোটি টাকার। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। এই চার মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায় কম হয়েছে ১২ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। তবে মোট আদায়ের অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। অর্জনের হার লক্ষ্যমাত্রার ৮৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। এই সময়ে কাস্টমস থেকে আদায়ের হার ৮৮ দশমিক ৬১ শতাংশ, মূসক থেকে ৯২ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং আয়কর ৮৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
অবশ্য কয়েকদিন আগে একই আভাস দিয়েছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। তিনি বলেন, পণ্যের কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ার কারণে চলতি অর্থবছরে স্থানীয় পর্যায়ে রাজস্ব আয় কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ভ্যাট ফাঁকি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও বলেছেন, পণ্য ও খাতভেদে ক্ষেত্র বিশেষে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি কমেছে, যার প্রভাব পড়েছে রাজস্ব আদায়ে। যদিও নভেম্বর পর্যন্ত ১৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। ভ্যাটের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে ফাঁকি বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যেমন ইএফডি মেশিন স্থাপনের পর গড়ে ৫০ হাজার টাকা করে ভ্যাট আদায় হচ্ছে প্রত্যেক দোকান থেকে, যা আগে ছিল ৪-৫ হাজার টাকা। সূত্রমতে, কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে সরকারে সর্বশেষ রাজস্ব আয়-ব্যয়, আমদানি, রপ্তানি, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খাদ্য উৎপাদন, জিডিপিসহ পুরো সামষ্টিক অর্থনীতির প্রতিটি সূচকের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে পর্যালোচনা করেছে অর্থ বিভাগ।
সেখানে বলা হয়, সরকারিভাবে গাড়ি কেনা বন্ধ। কিন্তু বেসরকারিভাবে গাড়ি কেনা বন্ধ নেই। এদিকে নজর দেওয়ার কথা আসে।
এছাড়া কৃচ্ছ সাধনের আওতায় সব ধরনের ভূমি অধিগ্রহণসহ অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। যে কারণে এসব খাতে ৪০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। এতে রাজস্ব আদায়ের চাপ কমে আসবে। সূত্র আরও জানায়, বৈঠকে বলা হয় আগামীতে বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণ কঠিন হবে। যে কারণে আগামী বাজেটের আকারও সম্প্রসারণমূলক করা যাবে না। সেখানে আমদানি ও রপ্তানি হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে।
সূত্রমতে, রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ আসে বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) থেকে। চলতি অর্থবছরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ বছর এডিপির আকার গত অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় ৩৫ হাজার ৪৩৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকার এডিপি ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বছরের মাঝামাঝিতে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয় অর্থ বিভাগ থেকে। বিশেষ করে ধীরগতি প্রকল্প থেকে বরাদ্দ কমিয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন প্রকল্পে বরাদ্দ, কৃষি, কৃষিভিত্তিক শিল্প, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বর্যা-উত্তর পুনর্বাসন, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে বলা হয়। এছাড়া উন্নয়ন খাতের কোনো অর্থ ব্যয় না হলে সেটি ভিন্ন খাতে (পরিচালনা) স্থানান্তর করতে নিষেধ করা হয়। অর্থছাড়ে কড়াকড়ি আরোপ করে এখন ১৮ হাজার কোটি টাকার এডিপি কাটছাঁট করা হচ্ছে। ফলে এখান থেকেও বছর শেষে রাজস্ব আদায় কমবে।