বঙ্গনিউজঃ বিসিবির এক পরিচালকের জানতে চাওয়া হলো বিশ্বকাপে ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত হবে কিনা। তাঁর উত্তর, ‘ক্রিকেটাররা ভালো করতে পারেনি। এ ব্যর্থতার দায় অন্য কার ওপর দেব!’
সত্যিই তো বিশ্বকাপে ভরাডুবির দায় তো কারও নয়। দায় আসলে তাদেরই, যারা নয়টি ম্যাচ খেলে সাতটিতে হেরেছেন। আর তারাও অভিযুক্ত, যারা ক্রিকেটারদের ব্যর্থতার কুশীলব ছিলেন। প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে দিল্লিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের আগের সংবাদ সম্মেলনে ব্যর্থতার দায় মাথা পেতে নিয়েছেন। অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও কলকাতায় নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচ-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের ব্যর্থতা মেনে নিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ এটি।
কিন্তু এই ব্যর্থতার পেছনে বিসিবি কর্মকর্তাদের কি একটুও দায় নেই? গত চার বছর দেশের ক্রিকেট কি ঠিকঠাক চালাতে পেরেছেন তারা? ২০১৯ সালের বিশ্বকাপের পর পরই কি ভারত বিশ্বকাপের পরিকল্পনা করে সব কিছু ঢেলে সাজিয়েছিলেন? এ রকম আরও অনেক প্রশ্নই তোলা যায় দেশের ক্রিকেট পরিচালনা পরিষদের সামনে। কিন্তু তাতে যে কোনো লাভ হবে না। কারণ তারা চলে তাদের নীতিতে। উটপাখির মতো মাথা গুঁজে!
২০১৯ সাল থেকেই বিশ্বকাপে সবচেয়ে অভিজ্ঞ দলের একটি বাংলাদেশ। মাশরাফি বিন মুর্তজার নেতৃত্বে উনিশের বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল খেলতে না পারায় আক্ষেপে পুড়েছে দেশ। লন্ডনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিডিয়ার সামনে মাশরাফিকে স্বার্থপর হিসেবে অভিহিত করেছিলেন সাকিব আল হাসান। নিয়তির কী পরিহাস, সেই সাকিবকে ভারত বিশ্বকাপ ছাড়তে হয়েছে সমালোচনায় জর্জরিত হয়ে। তা তিনি যতই বলেন না কেন– ছয় মাস আগে কোচ পরিবর্তন, টুর্নামেন্টের ঠিক আগে অধিনায়ক বদল নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সে। কিন্তু তারা সেরা এবং যোগ্য বলেই তো নেতৃত্বের ভার দেওয়া।
কোচ নিয়োগ আর অধিনায়ক মনোনীত করার সময় বিসিবি কর্মকর্তারা তো জানতেন না বিশ্বকাপের মাঠকেও পরীক্ষানিরীক্ষার মঞ্চ বানিয়ে ফেলবেন হাথুরু-সাকিব জুটি। কোচিং স্টাফ বা অধিনায়ক যখন ম্যাচের পর ম্যাচে স্বেচ্ছাচারিতা করেছেন, তা দেখেও চোখ বন্ধ করে ছিলেন কর্মকর্তারা। বিসিবি ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান জালাল ইউনুসের ভূমিকা নিয়েও তাই প্রশ্ন ওঠে। জাতীয় দল পরিচালনা বিভাগের প্রধান হিসেবে ব্যর্থতার দায় তিনিও কি এড়াতে পারেন? কারণ জাতীয় দল, কোচিং স্টাফ, নির্বাচক প্যানেল– সবই তো জালাল ইউনুসের অধীনে। তবে কি কোচ বা অধিনায়ক তাঁর কথা শোনেন না? বিশ্বকাপে ‘ঠকবাজির’ ব্যাটিং সাজানো আর ম্যাচের পর ম্যাচে দলের ব্যর্থতা মেনে নেওয়ার অর্থ হলো– জালাল ইউনুসের কথা টিম ম্যানেজমেন্ট শোনে না।
বিশ্বকাপের ব্যর্থতায় শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড ভেঙে দিয়েছে দেশটির ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। সরকারি হস্তক্ষেপের অপরাধে লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ডকে নিষিদ্ধ করেছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। বোর্ড হয়তো পুনর্বহাল করে নিষেধাজ্ঞা মুক্ত হবে। আবার স্বাভাবিক হবে দেশটির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। কিন্তু তারা তো একটা প্রতিক্রিয়া দেখাতে পেরেছে সাময়িক হলেও। পাকিস্তান দলের ব্যর্থতায় জাতীয় দলের কোচিং স্টাফ পুরো ছেটে ফেলা হচ্ছে, নির্বাচন কমিটি বরখাস্তের খবরও শোনা যাচ্ছে। করেছে। বাংলাদেশ সেখানে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।
বিসিবির নির্বাচক প্যানেলও কি এই দায় এড়াতে পারে? পারে না, কারণ গত ১০ বছরে মিনহাজুল আবেদীন নান্নুরা জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের শক্তিশালী একটি পুল তৈরি করতে ব্যর্থ। মূল একাদশের বিকল্প খেলোয়াড় খুঁজে বের করতে পারেননি তারা। যে কারণে বিশ্বকাপে তামিম ইকবালের বিকল্প করা হয়েছে অনভিজ্ঞ তানজিদ হাসান তামিমকে। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ভালো খেলা তাওহীদ হৃদয়ের ওপর অতি নির্ভরশীলতাও ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে বাংলাদেশ দলকে। অথচ বিশ্বকাপের আগে স্বপ্নের ডালা সাজিয়ে বসেছিলেন সবাই।
বাংলাদেশ দলের চরম ভরাডুবির পেছনে কিছু বিতর্কিত ঘটনাও ভূমিকা রেখেছে সাকিবের মেন্টর নাজমুল আবেদীন ফাহিমের মতে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বকাপের আগে তামিম ইকবালের অবসর, অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়া এবং পরে আরও যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা ছিল দলের জন্য ক্ষতিকর। যেটা ক্রিকেটারদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। সুন্দর ও ভালো পরিবেশ নিয়ে বিশ্বকাপে গেলে এই খেলোয়াড়রাই আরও ভালো করত। এ ছাড়া যে জিনিসটা বেশি প্রভাব ফেলেছে, তা হলো কোচ অনেক বেশি কিছু করতে গেছেন। যেটা হিতে বিপরীত হয়ে গেছে। বিশ্বকাপের মতো বড় টুর্নামেন্টে এসব করা ঠিক হয়নি। মোদ্দা কথা হলো দলটাকে পুরোপুরি প্রস্তুত করে নিয়ে যেতে পারেননি তিনি।’
বিশ্বকাপের প্রতিটি অনুচ্ছেদের ব্যবচ্ছেদ করা হলে কাঠগড়ায় থাকবেন প্রধান কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে আর অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। কারণ বিশ্বকাপের আগে ও বিশ্বকাপ চলাকালে যা কিছু ঘটেছে, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন তারা দু’জন। আর তাদের কথা মেনে বড় ভুল করেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।