শব্দদূষণ চোখে দেখা যায় না বলে এর ক্ষতিকারক বিষয়টি আমরা উপেক্ষা করি। অথচ শব্দদূষণ মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখ পর্যন্ত শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করে। মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ শুধু মানবজীবনেই নয়, জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর। এই শব্দদূষণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক বিরাট সমস্যা। বর্তমান আধুনিক যুগেও শব্দদূষণ নামক ব্যাধি আমাদের প্রতিনিয়ত অশান্তির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অতিরিক্ত শব্দদূষণের ফলে বাড়ছে মানসিক চাপ, কমে যাচ্ছে আমাদের স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি এবং সেই সঙ্গে বাড়ছে কানের বড় বড় জটিল সমস্যা। যার চিকিৎসাব্যয় সাধারণের আওতার বাইরে চলে গেছে।
শব্দদূষণ একটি অপরাধমূলক কাজ। শব্দদূষণের ফলে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া, কর্মক্ষেত্র, হাসপাতালের রোগীদের অতিরিক্তচাপ মানসিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। শব্দদূষণ বন্ধ করতে সরকার বহুবার চেষ্টা করেও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি, পাশাপাশি শব্দদূষণকারীদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থাও নেওয়াও সম্ভব হয়নি। ফলে দিন দিন তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। শব্দদূষণ রোধ করার জন্য সরকার হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এর পরও শব্দদূষণ কমছে না বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে।
পরিবেশবাদীরা বলেছেন, শব্দদূষণ এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে, যে এখন একে সন্ত্রাস শব্দ নামে অভিহিত করা যায়। অপদস্ত হওয়ার ভয়ে বেশির ভাগ মানুষ কোথাও অভিযোগ না করে নির্বিবাদে উচ্চশব্দের ভয়ংকর যন্ত্রণা সহ্য করছেন। শব্দদূষণ এক ধরনের মারাত্মক পরিবেশ দূষণ। আমাদের সঠিক অনুধাবনের অভাবে এ সমস্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, শব্দদূষণের মতো নীরব ঘাতক আর নেই। সাধারণভাবে আমরা যে শব্দ চাই না, সেটাই শব্দদূষণ। মানুষ ও প্রাণীর
শ্রবণসীমা অতিক্রম করে এবং শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে, সে শব্দকে আমরা শব্দদূষণ হিসেবে জেনে থাকি। দি ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্সের তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বের বসবাসের অনুপযোগী শহরের তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। আর অন্যতম প্রধান কারণ শব্দদূষণ। এই শব্দদূষণ এখন রাজধানী বা নগরীতে সীমাবদ্ধ নেই, উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সম্প্রতি সমন্বিত একটি অংশীদারত্বমূলক কর্মসূচির আওতায় সারা দেশে বিশেষ করে আটটি বিভাগের শহরের সদরে শব্দদূষণের পরিমাপ করে। সেখানে দেখা যায়, শব্দদূষণের জন্য মূলত গাড়ির হর্ন সবচেয়ে দায়ী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উচ্চশব্দের প্রধান উৎস যানবাহন থেকে হর্ন, ভবন নির্মাণের সামগ্রী, মাইক আর ইট গুঁড়ো করার যন্ত্র। তবে সামাজিক অনুষ্ঠানে অতি উচ্চমাত্রায় শব্দ সৃষ্টিকারী সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়। এতে প্রতিবেশীদের ঘুম হয় না, হৃদ রোগীদের হৃৎকম্পন বেড়ে যায়, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়। মানুষের কর্মক্ষমতা কমছে, গর্ভবতী মা ও শিশুদের ওপর উচ্চশব্দের প্রভাব আরো মারাত্মক। শব্দদূষণ বন্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না।
শব্দদূষণ রোধে আমাদের দেশে আইনের কমতি নেই। কমতি রয়েছে প্রয়োগের। ২০০২ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সংস্থা (বেলা) শব্দদূষণ বন্ধে আদালতে একটি রিট পিটিশন করে। ২০০২ সালের ২৭ মার্চ উচ্চ আদালত হাইড্রোলিক হর্ন এবং বিকট শব্দ সৃষ্টিকারী যেকোনো ধরনের হর্ন গাড়িতে সংযোজনের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং গাড়িতে বাল্ব হর্ন সংযোজনের নির্দেশ প্রদান করে। এই আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানও প্রচলিত আছে। এ ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর ২৫, ২৭, ২৮ ধারা মতে, শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড উভয়েরই বিধান রয়েছে। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ১৩৯ এবং ১৪০ নম্বর ধারায় নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহার ও আদেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী নীরব এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫০ ডেসিবল এবং রাতে ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ডেসিবল ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ডেসিবল ও রাতে ৬০ ডেসিবল এবং শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবলের মধ্যে শব্দের মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়। এই আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা চিহ্নিত করা হয়।
শব্দদূষণের বিরূপ প্রভাব শুধু মানবজাতি নয়, পশুপাখির ওপরও পড়ছে। শব্দদূষণের ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে বিলুপ্ত হচ্ছে নানা জাতের পশুপাখি। এ ক্ষতি পুড়ো বাঙালি জাতির। এভাবে চলতে থাকলে একসময় পশুপাখিগুলো আমাদের শহর থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে, যা আমাদের জন্য অমঙ্গল বয়ে আনবে।
বিধিমালা অনুযায়ী, নীরব এলাকা যেমন হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ, মসজিদ ও সরকার কর্তৃক ঘোষিত এলাকায় সামনের দিকে ৫০ ডেসিবল মাত্রার বেশি শব্দ ছড়ানো যাবে না। এই মর্মে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বর্তমানে ওইসব স্থানে ৮০ ডেসিবলের ওপরে শব্দের মাত্রা রয়েছে। এতে ব্যাপকভাবে শব্দদূষণ হয়। এ কারণে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, মসজিদ এলাকার সামনের দিকে ৫০ ডেসিবল মাত্রার বেশি শব্দ ছাড়ানো যাবে না মর্মে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। নগরীতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে শব্দদূষণ। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারা দেশে ২০ শতাংশ মানুষ বধির এবং ২০ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু। প্রায় ১১ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশের শ্রবণ সমস্যা রয়েছে। আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ৭১ শতাংশ মানুষ শব্দদূষণের কারণে হতাশা ও উদ্বেগের মতো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় সদিচ্ছার পাশাপাশি সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। শব্দদূষণ একটি মানবসৃষ্ট নিয়ন্ত্রণযোগ্য পরিবেশগত সমস্যা। আমরা বাড়িতে, অফিসে, রাস্তায় এমনকি অবসর সময়েও শব্দদূষণের শিকার হই। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে, বাস, ট্রেন, জাহাজ, কলকারখানা এবং লাউডস্পিকারের আওয়াজ নির্দেশিত স্তরে বা নিচে বজায় রাখতে হবে; যানবাহন থেকে নির্গত শব্দের তীব্রতা হ্রাস করার জন্য উন্নত প্রযুক্তির ইঞ্জিন এবং সাইলেন্সার ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত; সামাজিক অনুষ্ঠানে ডিজে পার্টি বা ব্যান্ড মিউজিকের আয়োজন করা হয়, যা শব্দদূষণের সৃষ্টি করে, যার ফলে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিসহ আশপাশের প্রায় সবার সমস্যা হয়; লাউডস্পিকার ব্যবহার নিষিদ্ধ করা; বিয়েবাড়ির প্যারেডে ব্যান্ড বাজানো, পটকা ফাটানো বন্ধ করা; শব্দদূষণ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সক্রিয় হওয়া; একই সঙ্গে বিবেক নিয়ে সক্রিয় নাগরিকের ভূমিকা পালন করলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমরা বিশ্বাস করি যে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
তথ্যসূত্র: লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।