বঙ্গনিউজঃ বৈদেশিক দেনা শোধের চাপে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে পরিশোধ করা হয়েছে ৮৭ কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১১০ টাকা হিসাবে) প্রায় ৯ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।
কিন্তু গত অর্থবছরের একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ৫২ কোটি ৫৬ লাখ ডলার বা প্রায় ৫ হাজার ৭৮১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এ হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিশোধ বেড়েছে ৩৪ কোটি ৪৪ লাখ ডলার বা প্রায় ৩ হাজার ৭৮৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
এমনকি আগের মাসের তুলানায় পরের মাসে বাড়ছে দেনা শোধের পরিমাণ। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ প্রসঙ্গ জানতে চাইলে ইআরডির সচিব শরিফা খান বলেন, আপনারা শুধু নেগেটিভ সাইডটিই দেখেন। পজিটিভ কিছু দেখেন না। এখন আমাদের ঋণ শোধের পরিমাণ বাড়াটাই স্বাভাবিক।
এ বিষয়ে আমাদের প্রস্তুতি আছে। আগামী দিনে বড় বড় ঋণের কিস্তি দিতে হবে, তাই এ অংশের ব্যয় আরও বাড়বে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আগে ছোট ছোট ঋণ ছিল। এখন আমদের ঋণের আকার বেড়েছে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সুতরাং বেশি অর্থের প্রয়োজন। তাই যখন পরিশোধের সময় আসবে, তখন তো সেটি দিতেই হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনোদিন কিস্তি পরিশোধে সমস্যায় পড়েনি। আশা করছি, আগামী দিনেও হবে না।
সূত্র জানায়, জুলাই-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থার সুদ ও আসল মিলিয়ে পরিশোধ করা হয় ৮৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে সুদ হিসাবে ৩৭ কোটি ৮৪ লাখ এবং আসল ৪৯ কোটি ২০ লাখ ডলার দেওয়া হয়েছে।
গত অর্থবছরের এই তিন মাসে ঋণ পরিশোধে যে অর্থ দেওয়া হয়েছিল, এর মধ্যে সুদ ১৩ কোটি ৭০ লাখ এবং আসল ৩৮ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তুলনামূলক সুদ পরিশোধের পরিমাণ দ্রুত বাড়ছে।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী শনিবার বলেন, বড় বড় প্রকল্পের বেশির ভাগ ঋণই স্বল্প গ্রেস পিরিয়ড (রেয়াতকাল) এবং পরিশোধের সময়ও কম। সেগুলো পরিশোধের সময় এসেছে। আগামী দিনে দেনা শোধের পরিমাণ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়বে। এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে অর্থছাড় কমেছে। পাশাপাশি রিজার্ভেরও সংকট আছে।
এছাড়া বৈশ্বিক এবং দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে প্রকল্পের গতি বৃদ্ধি কিংবা রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হবে কি না, সন্দেহ আছে। সবকিছু মিলিয়ে বৈদেশিক অর্থ ব্যবস্থাপনায় বড় চাপ আসতে পারে। এজন্য স্বল্প মেয়াদে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব কারণে হুন্ডি বেশি আকর্ষণীয়, সেসব কারণ খুঁজে বের করে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনা বাড়াতে হবে। এককথায় বলা যায়, বর্তমান পরিস্থিতি সামলাতে স্বল্প মেয়াদে রেমিট্যান্স বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
এদিকে উন্নয়ন প্রকল্পের গতি কম থাকাসহ নানা কারণে কমছে বৈদেশিক অর্থ পাওয়ার পরিমাণ। চলতি অর্থবছরের গত তিন মাসে উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ১২৮ কোটি ১৭ লাখ ডলার। এর মধ্যে ঋণ ১২৩ কোটি ১২ লাখ এবং অনুদান ৫ কোটি ৫ লাখ ডলার।
গত অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় হয়েছিল ১৩৪ কোটি ৯২ লাখ ডলার। এর মধ্যে ঋণ ১২৯ কোটি ৮০ লাখ এবং অনুদান হিসাবে ছাড় হয়েছে ৫ কোটি ১২ লাখ ডলার। তুলনামূলক অর্থছাড় কমেছে ৬ কোটি ৭৫ লাখ ডলার।
অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, অর্থনৈতিক সংকট বিদ্যমান থাকলেও চলতি বছর থেকেই বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ধাক্কা ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে।
২০২৭ সালে গিয়ে সেটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে এবং তা পরবর্তী কয়েক বছর চলবে। বিশেষ করে সুদাসলসহ পরিশোধ শুরু হবে চীন, ভারত এবং এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) ঋণের। এছাড়া গ্রেস পিরিয়িড (রেয়াতকাল) শেষ হয়ে ২০২৭ সালে শুরু হবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল ঋণের কিস্তি।
২০২৮ সালে শুরু হবে মেট্রোরেল প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম। এ পরিপ্রেক্ষিতে ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়বে। চলতি অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৭৮ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। ২০২৯-৩০ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ৫১৫ কোটি ডলার খরচ হবে। এরপর ঋণ পরিশোধ কমতে থাকবে।
বিদ্যমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে আগামী তিন বছর বাংলাদেশের ক্রমপুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণও বাড়তে থাকবে বলে জানা গেছে।